- প্রথম বছরে আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ
- পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা
- ভবিষ্যতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে
অগ্রসর রিপোর্ট :
স্বপ্নের পদ্মা সেতু ঘিরেই সোনালী ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাসহ ২৯ জেলার মানুষ। সেতুটি পুরোপুরি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। দ্বার খুলবে রাজধানী ও বন্দরনগরী কেন্দ্রীক উন্নত আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার। পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, বিমানবন্দরসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা ভাবছে সরকার। এতে সেতুর আশপাশের এলাকায় গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। পদ্মা সেতুসংলগ্ন জাজিরায় গড়ে তোলা হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতু সরকারের সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ। এতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিনদিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোলস্থল বন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। এতে রফতানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের প্রবাহ বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত। সেতুর মাওয়া অংশ থেকে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করবে। এতে পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।
সেতু চালু হলেই বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে
পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। এই সেতু চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে যে ইতিবাচক গতি তৈরি হবে, প্রথম বছরে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে প্রাপ্তির পরিমাণ হবে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশি।
দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পদ্মা সেতু কী ধরনের ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ‘সারাক্ষণ’কে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতি যুক্ত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বেড়ে জাতীয় আয়ে যোগ হবে। কারণ পদ্মা সেতুর সঙ্গে ওই অঞ্চলের অনেক অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে। এই সেতুর কারণে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়ে যাবে। এশীয় হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এই সেতুর যোগাযোগ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ বাংলার রাস্তাঘাট, টোলপ্লাজাসহ সবকিছুতে বড় ধরনের উন্নয়নের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালুর সুফল পুরোপুরি পেতে হলে দক্ষিণ বাংলায় নেয়া মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। বিশেষ করে মোংলা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্পে গতি আনতে হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ বাংলার উদ্যোক্তাদের ভেতরে এক ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কনফিডেন্স তৈরি হচ্ছে। এই সেতুকে ঘিরে শিপ বিল্ডিং, পর্যটন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতের বড় ধরনের বিকাশ ঘটবে। ওই অঞ্চলে গড়ে উঠবে পর্যটন কেন্দ্র। ঢাকা থেকে সরাসরি সেখানে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যাবেন। এজন্য স্ট্যাচ্যু অব লিবার্টির মতো দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর ভার্স্কয, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ করা যেতে পারে।
আতিউর রহমান বলেন, দক্ষিণাঞ্চল থেকে জলবায়ু উদ্বাস্তু অনেকে ঢাকায় চলে আসছেন। কিন্তু করোনায় ফিরে গেছেন বেশির ভাগ। পদ্মা সেতু চালুর পর ফিরে যাওয়া লোকজনের ৫০ শতাংশ আর ঢাকামুখী হবেন না। এতে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে মাইগ্রেশনের চাপ কমবে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের কৃষি ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ডিসিসিআইয়ের মতে, পদ্মা সেতুর ফলে কমপক্ষে ৫০ বছর সুবিধাভোগ করা সম্ভব হবে। পদ্মা সেতু জিডিপিতে ১ শতাংশের বেশি অবদান রাখবে। যোগাযোগ সুবিধা বাড়বে, কর্মসংস্থান বেশি হবে, অর্থনৈতিক গতিশীলতা আরও বাড়বে, পণ্য নষ্ট কম হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের কর্মসংস্থান
সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষিকাজের প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারা দেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ‘সারাক্ষণ’কে বলেন, সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সাথে একটি সংযোগ তৈরি হতে পারে। পদ্মা সেতুর সুবিধা পাওয়ার জন্য এখন আমাদের যথাযথ কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি এর সুবিধাগুলো কাজে না লাগাতে পারি তাহলে কেবল সেতু তৈরি করে কোনো লাভ নেই। আমাদের এখন সেখানে অর্থনীতি-ভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দিতে হবে। শিগগিরই এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথম বছরেই ২৪ হাজার যানবাহন চলবে
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণে যানবাহন চলাচল করবে, তা নিয়ে ২০০৯ সালে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালের শুরুতে যদি পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়, তাহলে ওই বছর সেতু দিয়ে চলাচল করবে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন। সংখ্যাটি প্রতিবছরই বাড়বে। ২০৫০ সালে প্রায় ৬৭ হাজার যানবাহন চলবে পদ্মা সেতু দিয়ে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, তাদের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। এ সমীক্ষায় রেল সংযোগের বিষয়টি ছিল না। পরে যেহেতু রেল যুক্ত হয়েছে, সেহেতু সেতুটি আরও বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, পদ্মা সেতু তৈরিতে ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে, রেল সংযোগে যে ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে, সেটাও জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ, প্রকল্পের ব্যয়ের টাকা জিডিপিতে যোগ হবে। পরোক্ষভাবে চাহিদা বাড়াবে পণ্য ও সেবার।