অগ্রসর রিপোর্টঃ ‘১০-১২ বছর পর আবার নিজের স্বাভাবিক হাত দেখতেছি। সবার মতোই হাত খুলে চলতে ফিরতে পারতেছি…’ নিজের হাতের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছিলেন আবুল বাজানদার। যাকে বৃক্ষমানব বলে ডাকা হতো, সেই বাজানদারের হাতের আঙুলে গজিয়ে ওঠা শেকড়ের মতো উপাদানগুলো আটবারের অপারেশনে মুক্ত হয়েছে। রবিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে বাজানদারের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখা গেলো, বারবারই তিনি নিজের হাতের দিকে তাকাচ্ছেন, খুশিতে হাসছেন। আর খুশিতে ভিজে উঠছে চোখ। বাজানদার বলেন,‘ভালো লাগতেছে যে হাতটা আবার স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসতেছে আস্তে আস্তে।আগে কী অবস্থায় ছিল আর এখন কোন পর্যায়ে আসছে।…এটা খোদা নিজে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।মেয়েকে কোলে নিতে পারবো, নিজের হাতে খেতে পারবো, আবার কাজ করতে পারবো-আমার জীবন পুরোটাই আবার বদলে গেলো।’
হাতে কোনও জ্বালা-পোড়া কিংবা ব্যথা নেই জানিয়ে বাজানদার বলেন,‘এখনতো শুধু ব্যায়াম করতে বলছে স্যাররা (চিকিৎসক)। তাই করে যাচ্ছি, আঙ্গুলগুলো নাড়াইতে গেলে কেমন জানি লাগতাছে, এত বছর ধরে হাতের কোনও আঙ্গুল চোখে দেখি নাই, কাল থেকে কতবার যে হাতের দিকে তাকাইয়া থাকছি, এটা কী আমার হাত কিনা সেই নিয়া ধন্দ (দ্বিধা) লাগতেছে।’
নিজের ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত হাতের আঙ্গুলগুলো ছিল, তার পরেই এই অসুখে পড়েন বাজানাদার।
‘ওনার হাত দেখে ভালো লাগতেছে’, এক মুখ হাসি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন বাজানদারের স্ত্রী হালিমা খাতুন। ‘ডাক্তাররা বলেছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে হয়তো মুঠ (মুষ্টিবদ্ধ) করতি পারবে, আবার স্বাভাবিক হচ্ছেন উনি-এতেই খুব খুশি।’
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আবুলের পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।ডান হাতটা বেশি ইমপ্রুভড করে গেছে, বাম হাতে হয়তো আর দুই কিংবা একটি অপারেশন লাগতে পারে।আর দুইপায়ে মাত্র একবার অপারেশন হয়েছে।
তিনি বলেন,‘ডান হাতে বাজানদার কলম ধরতে পারছে। আমাদের বিশ্বাস, আর কিছুদিন পরেই বাম হাতেও ডান হাতের মতো উন্নতি হবে, বাজানদার নাউ ইজ ইন অ্যা ভেরি গুড শেইপ’ বলেন তিনি। যে বাজানদারকে আমরা এখানে ভর্তি করেছিলাম জানুয়ারির ৩০ তারিখে, সেই বাজানদার আর আজকের বাজানদারের চেহারা-পুরোই বদলে গেছে, তার হাসি দেখলেইতো সব বোঝা যায়।
বাজানদারের দুই হাতে মোট আটটি আর পায়ে একটি অপারেশন হয়েছে।ডা. সেন বলেন, গত সোমবারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম বার্ন ইন্সটিটিটিউট প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে।তখন হঠাৎ করেই মনে হলো, বাজানদারের হাতের একটি ফটোগ্রাফ আছে আমার কাছে।তখন তাকে এটি দেখাই, উনি খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ওকে সুস্থ করার জন্য যতটুকু করার দরকার, হাসপাতালে যতদিন থাকা দরকার রাখবা এবং ওকে সুস্থ করে তুলবা’।
এখন বাজানদারের ফিজিও থেরাপি লাগবে, কারণ হাতের আঙ্গুলগুলো এতোদিন স্টিভ হয়ে ছিল।আজ এতবছর ধরে আঙ্গুলগুলো বন্ধ হয়ে ছিল, এখন ব্যায়াম করলেই সেগুলো সচল হয়ে যাবে। কয়েকটি অয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে তাকে, ডান হাতে ঐ ওষুধগুলো লাগাতে হবে নিয়মিতভাবে, তাহলেই হাতের ওপরের অংশটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, বলেন তিনি।
হাতের ওপরের শেকড়ের মতো অংশগুলো আপাতত মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এটাই এখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ।যেন তার হাতে এগুলো আর ফেরত না আসে। সার্জিক্যাল একটা অপারেশন করে একটা স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে, এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এগুলো যেন আর না হয়। সেজন্য আমেরিকাতে এই রোগের বিশেষজ্ঞ কাস্ট মার্টিনের কাছে বাজানদারের টিস্যু, রক্ত, মূত্রসহ বেশ কিছু জিনিস পাঠানো হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আমেরিকা এবং চীনেও ওরা কাজ করছে। এজন্য একটু সময় লাগছে, তারা গবেষণা করছে এই রোগটি নিয়ে। তারা আমাদের জানাবে, এগুলো যেন আর ফেরত না আসে সে জন্য কী কী সতর্কতা নিতে হবে আমাদের।
ডা. সেন বলেন, বাজানদারকে দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে, বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা হয়, বাংলাদেশের চিকিৎসা ইতিহাসে বাজানদার একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘ সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সবাই যদি নিবিষ্টভাবে কাজ করে তাহলে বাংলাদেশেও উন্নত চিকিৎসা সম্ভব, সেটা বাজানদারের অপারেশন দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। যে কোনও চিকিৎসায় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায়, চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে এনেছে বাজানদার ‘
‘বাজানদারের অপারেশন ছিল আমাদের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ। কারণ, আঙ্গুলগুলো তখন দেখা যেত না।অপারেশনের সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন কোনও আঙ্গুলের ভেতরে থাকা শিরা কেটে না যায়, শিরা কেটে গেলে আঙ্গুলই চলে যেত। বাজানদারকে নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি, এখন পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি,’ বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
উল্লেখ্য, বিরল রোগ ইপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভ্যারুসিফরমিসে আক্রান্ত বাংলাদেশের আবুল বাজানদার বিশ্বের এ ধরনের তৃতীয় রোগী।গত ৩০ জানুয়ারি খুলনার আবুল বাজানদার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন এবং তার চিকিৎসায় বর্তমানে ৯ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড কাজ করছে।তার চিকিৎসার সব খরচ বহন করছে সরকার।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।