রবীন্দ্রনাথ মূলত ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক কবি। প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে মানব জীবনের সন্ধান করেছিলেন। প্রকৃতির মাঝে মানবের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। জীবনের বেশ কিছু কাল কোলকাতার জোড়াসাঁকো আর পদ্মা প্রকৃতি, শিলাইদহ, কুষ্টিয়া প্রভৃতি জায়গায় কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও প্রকৃতির উপস্থিতি অবাধ। তাঁর গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্য সর্বত্রই প্রকৃতিকে ঘিরে। প্রেম, রাজনীতি, সমাজ প্রভৃতি নিয়ে লিখলেও তিনি প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন একটু বেশি।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেম বিশাল। ওঁর দৃষ্টিতে প্রকৃতি নিছকই মানুষের উপভোগ বা রসাস্বাদনের বিষয় নয়। তিনি প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে শুনেছিলেন জননী বসুন্ধরার অমোঘ প্রেম। এত বিশাল ছিল রবি ঠাকুরের উপলব্ধি। এতো গভীর ছিলো তাঁর প্রকৃতি প্রেম।
এপ্রসঙ্গে “ছিন্নপত্র”-এর অনেক পত্রে রবীন্দ্রনাথ বসুন্ধরা অর্থাৎ এই পৃথিবীর সাথে আদি কালের সম্পর্কের কথা জানাচ্ছেন। যে সময়ে তিনি ভেসে বেড়াচ্ছেন পদ্মার বুকে বোটে করে। আর সৃষ্টি করছেন একটার পর একটা মহামূল্যবান সাহিত্য।
“ছিন্নপত্র” পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ কতখানি প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ ছিলেন। কত গভীর ছিল তাঁর এই প্রেম।
“ছিন্নপত্র”-এর ১০, ১৮, ৬৭, ৬৪, ১০২, ১০৮ প্রভৃতি পত্রে আমরা সেই প্রেমের পরিচয় পাই।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, পৃথিবী সৃষ্টির আদিলগ্নে যখন কোনো প্রাণের সঞ্চার হয়নি। পৃথিবী তখন এক বিশাল সমুদ্র হয়ে দুলছে। আর চারিদিকে জল আর জল। কবি বলছেন তিনি সেই সময়েও ছিলেন। এক তৃণ রূপে। ছোটো একটি গাছের পাতা হয়ে তখন তিনি পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিলেন। আর সূর্যের প্রথম আলোতে তাঁর মধ্যে নবপ্রাণের সঞ্চার হত।
রবীন্দ্রনাথ আরো বলছেন, ধীরে ধীরে সেই গাছ থেকে সৃষ্টিচক্রের মাধ্যমে আমাদের উন্নত মানব জীবন গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের এতটাই গভীর প্রেম।
কবি আরো বলছেন, তিনি আর প্রকৃতি যখন মুখোমুখি বসেন তখন রবীন্দ্রনাথের যেন মনে হয় এই পৃথিবীর সাথে তাঁর বহুকালের পরিচয়। আর সেইটাই যেন কবি তাঁর সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন।
ওই পদ্মা পাড়ের কাছে এলেই কবির বারে বারে মনে হত পদ্মা বোধহয় পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু বারেবারেই কবিকে আশ্চর্য করে দিয়ে পদ্মা নতুন রূপে রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হয়েছে। এত গভীর ছিলো রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ।
“ছিন্নপত্র” ছাড়াও কবির
“সোনার তরী”তে শুধুই প্রকৃতি নয় তার সাথে সাথে পৃথিবীর কথাও বললেন।
“যেতে নাহি দিবো” কবিতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন তাঁর বসুন্ধরা মায়ের এক করুণ রূপ। আশ্চর্য এক নিরাসক্তি। কবির ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না পৃথিবী মাতাকে। তবু যেতে হবে। তবু সবাই সমস্ত মায়া কাটিয়ে একদিন চলে যায়। শুধু পড়ে থাকে রিক্তা, দুখিনী মা। ধরে রাখতে পারে না কাউকেই।
ছোটো শিশু কন্যার মধ্যে কবি খুঁজে পেলেন মাতা বসুন্ধরাকে। “যেতে নাহি দিবো” কথাটি শিশুর মুখ থেকে বেরোলেও এ যেনো সমস্ত পৃথিবীর এক চিরন্তন ক্রন্দনধ্বনি।
প্রকৃতি প্রেমিক অনেক বিখ্যাত চরিত্র বাংলা সাহিত্য পেয়েছে যা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। ছোটোগল্পের অধিকাংশ চরিত্রই প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা। যেমন – “সুভা” গল্পের “সুভা”, “পোস্টমাস্টার”-এর রতন, “অতিথি” গল্পের তারাপদ, “সমাপ্তি”র মৃন্ময়ী সকলে কোনো না কোনোদিক থেকে প্রকৃতির সন্তান।
রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রকৃতি নিছকই ঠুনকো বিষয় নয়। এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতির সন্তান রবীন্দ্রনাথ বারংবারই তাঁর জীবন ও বিচিত্র সাধনায় প্রকৃতিকে এক পৃথক স্থান দিয়েছিলেন। কবি বলেছিলেন – “আমার পৃথিবী তুমি বহু বরষে”। সত্যি রবীন্দ্রনাথের সাথে এই পৃথিবীর যেনো জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। তাই তাঁর সাহিত্যেও প্রকৃতিই ছিল অন্যতম বিষয়।
কোলকাতার জমিদার বংশের সন্তান হয়ে একদা কবি বলেছিলেন, কোলকাতায় থাকলে প্রকৃতিকে ভুলে যেতে হয়। সত্যি অতো বিশাল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মানুষ হয়েও একদা বালক রবি বলেছিলেন – “বিশ্ব প্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতে হইতো”। একদা ঘরের কোনে বসে থাকা ছোট্ট রবিকে প্রকৃতি যেভাবে টানতো, বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে সেই টান যেন আরো বাড়ে।
বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতি প্রেমিক কবি তো অনেক আছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতন এত গভীর প্রেম, এত বিশাল ভাবে ভাবতে কোনো কবিই হয়তো পারেন নি। তাই রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ প্রকৃতি প্রেমিক কবি। পৃথিবীর প্রতি গভীর আকর্ষণের সাথে সাথে তিনি আজও বিশ্বকবি।।