মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
বিংশ শতাব্দী সবে শুরু হয়েছে। গোটা উপমহাদেশ তখনো উপনিবেশবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনগন। জেল-জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন ছিল অন্নহীন, বস্ত্রহীন, স্বাস্থ্যহীন মানুষের নিত্যসঙ্গী। ঠিক এমনই এক প্রতিকূল পরিবেশে গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর তীরঘেঁষে ছবির মতো সাজানো নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় এক শিশুর জন্ম হয়। সংগ্রাম ও স্বাধীনতা তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে, এই দুয়ের পেছনেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের পঁচিশটি বছর।
নির্ভীক, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অনুপ্রেরণা, নিঃশঙ্কচিত্তে দেদীপ্যমান এক কিংবদন্তি তিনি। ‘রাজনীতির মাঠ থেকে জেল’, ‘জেল থেকে রাজনীতির মাঠ’- এই ছিল তাঁর জীবন। তিনি বলতেন, ‘জেল আমার আরো একটা বাড়ি’। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণের দায়ে জেল। মুক্তির পরই জানলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছাত্রত্ব নেই, সেদিন থেকেই পুরোপুরি শুরু তাঁর ঝঞ্ঝাপূর্ন রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২; ‘৫৪, ‘৬৬ কিংবা ‘৬৯-‘৭০ এবং ‘৭১ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামেই তাঁর অবদান ছিল প্রশ্নাতীত।
৫৫ বছরের জীবনে অসংখ্যবার (মোট ১৮) কারাভ্যন্তরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দিন-বছর হিসাব করলে যা ৪ হাজার ৬৮২ দিন এবং ১২ বছরেরও বেশি সময়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই জেলবরণের সময়ে তাঁর জীবনের সৃষ্টিশীল সময়গুলোর এক-চতুর্থাংশ। তিনি বাঙালির হাজার বছরের ধন্য পুরুষ, কোটি কোটি মানুষের মনের জীবন্ত স্মৃতির মিনার। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
ভালোবেসে বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা শেখ সায়েরা খাতুন তাঁকে ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের মুখে ‘মিয়া ভাই’। বাঙালি জাতির স্থপতি হিসেবে আমরা সম্মান জানিয়ে ডাকি ‘জাতির পিতা’; যদিও বাস্তবে তিনি বাঙালির বন্ধু, বাংলার বন্ধু, সর্বোপরি আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু’। অল্প কথায়, স্বল্প পরিসরে তাঁর গুণবিশেষ কিংবা বিচিত্র কর্মময় সংগ্রামী জীবনকথা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করা দুরূহ।
বাঙালির জন্য তাঁর কর্মব্যাপ্তি, ত্যাগ, সংগ্রাম, নিষ্ঠা; ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন, স্বপ্ন, দর্শন, আদর্শ ও প্রাপ্তি এতটাই ছড়িয়ে রয়েছে তা দিয়ে একটি মহাভারত লিখলেও কম হয়ে যাবে। শতবর্ষ পেরোনো সেই শেখ মুজিব এখন আরও শত কোটিগুণ শক্তিশালী, শ্রদ্ধেয়। আজ সতেরো মার্চ; ইতিহাসের এই অগ্নিপুরুষের ১০৪তম জন্মদিন। ফুল-মাল্য আর শ্রদ্ধায় উদযাপনের অনন্য দিন। বাঙালি জাতির জাগৃতির ইতিহাসে বরাবরই ভাস্বর ছিল ১৭ মার্চ। যদিও তাতে ঢের আপত্তি ছিল স্বয়ং জাতির জনকের।
স্বাধীনতাপরবর্তী বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনের স্নিগ্ধ সকালে শত শত অনুরাগী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সমাগত, মহানায়ক এসে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘আমার আবার জন্মোৎসব কিরে? আয় তোরা কাছে আয়।’ বঙ্গবন্ধুর এ ডাক নেহাত আমন্ত্রণ নয়, যেন সাগরের আহ্বান। তিনি বলতেন, ‘বাংলার দুঃখী অনাহারী মানুষ জন্মদিনের বার্তা বোঝে না। আমিও তাই বুঝতে চাই না। আমি যে তাদেরই একজন।’ সত্যিই তো! জীবন যার রাজনীতির ঝড়ো খেরোখাতায় ভরা, ব্যক্তিগত উৎসব পালনের সময় কই তার?
জাতির পিতার কাছেও কোনো উৎসব কখনো গুরুত্ব পায়নি। নিজের জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠান তো নয়-ই। জন্মদিন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনীহার কথা ১৯৭৩ সালে জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার এক সাক্ষাৎকার থেকেও জানা যায়। যেখানে তিনি বলেন, ‘জন্মদিন উদ্যাপন আব্বা কোনোদিনও পছন্দ করেন না। আব্বা বলেন, যে দেশের মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রাম করতে হয় মৃত্যুর সাথে; প্রতিদিনই তো তাদের জন্মদিন।
বিশেষ একদিন অথবা ক্ষণেকের বৈশিষ্ট্য মাপার মতো সময় বা অবস্থায় তাদের কোথায়।’ কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বলেন, ‘আব্বা মনে প্রাণে বাঙালি। বাংলার ঐতিহ্যের সাথে মেশানো প্রতিটি জিনিসকে আব্বা যেমন পছন্দ করেন, তেমনি বিদেশী কোনো আচার-অনুষ্ঠানকে আব্বা এড়িয়ে চলেন। আব্বা বলেন, জন্মদিন শব্দটার সাথে কেমন যেন বিদেশী ছোঁয়া লাগানো। আমাদের বাসাতে তাই কোনো জন্মদিনের উৎসব হয় না। শুধু আব্বার জন্মদিনে প্রত্যেক প্রভাতে বাগানের তাজা একটা ফুল তাকে আমি উপহার দেই।’ (১৭ মার্চ, ১৯৭৩; দৈনিক বাংলা)
(২)
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে নেতৃত্বে মহানায়ক, ঝোলে-ঝালে-অম্বলে ১০০-তে ১০০ এমন তারকা রাজনীতিকের সংখ্যা খুব বেশি নেই। তারপরও যদি প্রশ্ন ওঠে, আসলে কত বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু? বাঙালির জীবনে কতটা প্রভাব তাঁর? এসব প্রশ্ন ব্যাখ্যাতীত, উত্তরও অনেক। তারপরও বলা যায়, শেখ মুজিব যতটা না রাজনীতির মারপ্যাঁচে দেশ গড়েছেন, তার চেয়ে বেশি গড়েছেন লাখ লাখ মানুষের আবেগ, কান্না আর রক্ত দিয়ে।
তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক কিংবা হোসেন শহীদ সোহারওয়ার্দীর মতো রুপার চামুচে নন; বাংলাদেশের আর লক্ষ কোটি জনের মতোই তিনি এই মাটি থেকে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন কাদা-মাটির সঙ্গে খেলতে খেলতে। জাতির পিতা নিজেও বলতেন, ‘জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার চেয়ে বেশি কিছু চাই না; শুধু থাকতে চাই মাটির মানুষদের সাথে।
অস্বীকার করছি না, হয়তো জ্ঞানে-গুণে বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় অনেক বাঙালি এই বঙ্গে জন্মেছেন; কিন্তু অসহায়-নীপিড়িত মানুষের জন্য জীবন বাজি রাখা; বছরের পর বছর জেলবরণ একমাত্র বঙ্গবন্ধুই করেছেন। এখানেই তিনি অন্য সবার থেকে আলাদা, এখানেই তার অসাধারণত্ব। বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, ‘আমরা হয় ‘স্বাধীনতা’ নতুবা ‘বঙ্গবন্ধু’- দুটোর একটা পাব ভেবেছিলাম।
আমরা সৌভাগ্যবান যে স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু দুটোকেই পেয়েছি। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শুধু তোমরাই নও। আমরাও।’ এই ছিল দেশ ও বিশ্ব ভ্রহ্ম্যা-ে আমাদের জাতির পিতার অবস্থান।
১৯৪১ সালে পহেলা বৈশাখের এক অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত কুটিরে; অপেক্ষা করে থাকব সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে। চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শুনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’
বললে অত্যুক্তি হবে না, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের রাজ্যে এমন দুর্লভ চরিত্রের ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি কবির ভাষায় ‘কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তার অধিক/…সবিনয়ে সগৌরবে ধরা-মাঝে দুঃখ মহত্তম’-এর মতোই পাওয়ার চেয়ে দেয়ায় বেশি মেতে থাকতেন। বিনিময়ে দুঃখকেও মহত্তম হিসেবে গ্রহণ করতেন সবসময়।
(৩)
আমার সমগ্র জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল মধুর স্মৃতি এবং গৌরবময় প্রাপ্তি হলো বঙ্গবন্ধুর স্নেহ সান্নিধ্য ও তাঁর সংস্পর্শে আসা। বঙ্গবন্ধুর অমৃত বাণী আজও আমাকে তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব ধারণ করতে অনুপ্রেরণা যোগায়; তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের কাজে আসতে উৎসাহ জোগায়। একজন বাঙালির জীবনে এর থেকে পরমানন্দ আর কিছু হতে পারে কিনাÑ আমার জানা নেই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেশ কয়েক দফা সাক্ষাতের মধ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল হওয়া প্রথম আলাপ ছিল অনেকটাই আচমকা।
এর মাসখানেক আগেই শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরের গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে ৬ দফা পেশ করেন। এতে টনক নড়ে উঠে তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এবং তাঁর সরকারের। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগও ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্রলীগের ১১ দফা ঘোষণা পর বাংলার ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ৬ দফা ও স্বাধীনতা পূর্ব আন্দোলনে বাড়তি মাত্রা যোগ করতেই সেদিন পাবনা সফর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। মুগ্ধ হলাম। পরিচিত হওয়ার পরপরই ‘তুই’ সম্বোধনে তিনি আমার ব্যক্তিগত আদ্যোপান্ত জানতে চাইলেন। বললেন টাউন হলের জনসভায় যোগ দিতে। জানালেন রাজনীতি জানা-বোঝার আহ্বানও। এত বড় মাপের মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের কথা আমার কাছে শুধু নির্দেশ নয়Ñ আরো অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। আজ ভাবি, জনগণের জন্য উৎসর্গিত যে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে কোনো কিছুরই খোঁজ রাখতেন না।
আজ কী খাওয়া হবে, কাল কী পড়া হবে; এমনকি কোন জিনিসটা তার একান্ত প্রয়োজন, সেগুলোও যেখানে স্মরণ করিয়ে দিতে হতো কর্মসঙ্গীনী বেগম মুজিবকে, সেখানে আমার মতো এক কিশোর সম্পর্কে জানা, তাকে রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করা ছিল তার সুমহান স্বভাসুলভ বৈশিষ্ট্যেরই অংশবিশেষ মাত্র।
সীমাহীন গুণের অধিকারী এই বিশ্বনেতার কয়েক দফা সান্নিধ্য পেয়ে তাঁর সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন করা আমার জন্য কঠিন। তারপরও যতটুকু পেরেছি, সে হিসেবে আমি অতি সৌভাগ্যবানদের একজন। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, Bangabandhu was not only ‘a friend of Bengal’ but his role was more than that and incomparable. Noting that Bangabandhu was a fantastic person, He was snatched away from the Bangalees but nobody can snatch his clear thoughts and visions, which may be Ôvery helpful for us today’. অমর্ত্য সেন বলতে চাইছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে শুধু ‘বঙ্গবন্ধু’ বললে ভুল হবে; কারণ তার কর্মকাণ্ড এমন ছিল যা কারও সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
শুধু তাই নয়, অবিসংবাদিত ও মানবদরদি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বলেই ১৯৭১-এ সাত কোটি বাঙালি লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আবার তাঁর দেখানো আদর্শ ও গণতন্ত্রের ওপর ভর করেই ২০২৪-এর বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারো এলা সেই মহেন্দ্রক্ষন। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২; দীর্ঘ ৬ বছর পর শুভযোগ হলো ইতোমধ্যেই জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনীতিক হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর ছবক পাওয়া আমিও ততদিনে রাজনীতিতে বেশ পোক্ত। কাঁধেও বড় দায়িত্ব। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি।
এদিন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে বৃহত্তর পাবনা জেলাকে বন্যামুক্ত করতে নিজ হাতে মাটি কেটে ১৫৭.৫৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে আমরা পাবনাবাসী জাতির পিতাকে ভালোবেসে এই বাঁধের নামকরণ করি ‘মুজিব বাঁধ’। বাঁধটি নির্মাণ যে শুধু ওই সময়ের পাবনাবাসীর জন্য আশীর্বাদ ছিল তা নয়, বর্তমানেও এটি পদ্মা-যমুনা নদীবেষ্টিত পাবনার রক্ষাকবচ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
বাঁধ নির্মাণ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভার মঞ্চে উপবিষ্ঠ হলেন বঙ্গবন্ধু। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার স্বাগত বক্তব্য দিলাম আমি। বক্তব্য শেষ হলে জাতির পিতা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, কপালে চুমু দিলেন এবং বক্তব্যকে ‘অসাধারণ’ আখ্যা দিয়ে প্রসংশা করলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখে এমন প্রশংসা শুনে এই ভেবে উৎসাহী হলাম যে, মাত্র ১৮মিনিট বক্তৃতায় যিনি সাত কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন, লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন; সেই মানুষটি যখন আমার ভাষণের প্রশংসা করলেন, তখন সেটা নিঃসন্দেহে আমার পরম পাওয়া।
জাতির পিতাকে বিদায় দিতে যাচ্ছি, এমন সময় তিনি আচমকা প্রস্তাব দিলেন বঙ্গবন্ধু। বললেন- ‘হেলিকপ্টারে তার সঙ্গে ঢাকায় যাব কি না?’। কে চাইবে ওই বয়সে রাষ্ট্রতির সঙ্গে হেলিকপ্টার ভ্রমণের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে! আমিও করিনি। মহানায়কের সঙ্গে জীবনের প্রথমবার হেলিকপ্টার ভ্রমণ করলাম। বঙ্গবন্ধু অনেক কথা বললেন, উপদেশ দিলেন। হেলিকপ্টার নামল রাজধানীর পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে।
সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন
১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনা আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হলো। বঙ্গবন্ধু চলে যাওয়ার দু’মাস আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল।
পাবনা জেলা বাকশাল কমিটিতে পদ পাওয়ায় ওই সাক্ষাৎ হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। জাতির জনক সেদিন তাঁর স্বভাব ড্রেসকোড ‘হাফ-শাটর্’ ও ‘লুঙ্গি’ পরেছিলেন। বাসায় ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম এবং বাকশাল কমিটিতে স্থান দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাদের নানা দিকনির্দেশনা দিলেন। চলে আসব, ঠিক এই মুহূর্তে বললেন- ‘কীরে, আমার সাথে ছবি তুলবি না?।’ তাৎক্ষণিক ক্যামেরাম্যান আসলেন এবং দেশনায়কের সাথে আমাদের ছবি তুললেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নেওয়া সেই ছবি আজও আমার কাছে থাকাতার শেষ স্মৃতি চিহ্ন।
(৪)
বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ও সাধ ছিল বাংলাদেশের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফুটানো, তাদের সুখী ও সন্তুষ্ট করা। বাঙালিকে তিনি শুধু জাতীয়তবাদের অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করেননি, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে একটি জাতিতেও রূপান্তর করেছেন। দিয়েছেন মুক্তির পূর্ণ স্বাদ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দেওয়া।
পাশাপাশি ১৫ মাসের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করতে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা। ইচ্ছে করলেই তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারতেন, কিন্তু তা করলেন না; জনগণের রায় পেতে দিলেন সাধারণ নির্বাচন। এই হলেন আমাদের জনগণের নেতা।
প্রিয় জাতির পিতা, আপনি আজ নেই। কিন্তু শৈলশিখরের মতো আজও আপনি আপন মহত্ত্বে ভাস্বর। আপনি ব্যক্তি নন, আপনিই একটি জাতি। আপনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে ছিলেন, আজ ১৭ কোটির আদর্শ হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। আমাদের শঙ্কা নেই, কারণ চেতনায়-আদর্শে আজও আপনি আমাদের পুরোভাগে আছেন।
১০৪ তম শুভদিনে আপনারপ্রতি রইল মস্তক অবনত শ্রদ্ধা, সম্মান! শুভ জন্মদিন আমাদেরমহানায়ক।
লেখক: রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।