বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ভেতর ১২ কোটি মানুষই কাউকে বিশ্বাস করে না। কাউকেই না। ওপরের দিকে ২ কোটি বৃদ্ধ আর নিচের দিকে ৪ কোটি শিশু- মোট ৬ কোটি বাদ দিলে থাকে ১২ কোটি। মাঝখানের কিছু মানুষ ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু এটাই মোটা দাগে সত্যি। পরিসংখ্যান ব্যবহার করলে এমনি আসবে।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? আচ্ছা চলুন শুরু করি।
আজকে রাতেই ডিনারের পর আপনি আপনার ছেলেমেয়েদের সামনে বসবেন। শিশুদের আমরা আগেই বাদ দিয়েছি। কিশোর এবং তার থেকে বড় সন্তানদের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?
প্রথমেই এ ধরনের প্রশ্নে তারা একটু অবাক হতে পারে। কিন্তু এই জেনারেশনের বাচ্চাগুলো অনেক স্মার্ট। সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারে, তুমি কী বোঝাতে চাইছ?
আপনি তখন বললেন, খুব সহজ একটি প্রশ্ন। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কি না?
আপনার ছেলেমেয়ে তখন একটু লম্বা গলায় বলতে পারে, আহা, কী ব্যাপারে বিশ্বাস করি?
যেই মুহূর্তে সে বলবে ‘কী ব্যাপারে’ কিংবা কোন বিষয়ে, তখনই বুঝবেন সে আপনাকে বিশ্বাস করে না। সে কিছু কিছু বিষয়ে আপনার ওপর নির্ভর করে, কিন্তু বিশ্বাস করে না।
আপনি যখন আরো পেঁচিয়ে ধরে জানতে চাইবেন, সেই জানায় কোনো লাভ নেই। সে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ভিন্ন পথ বেছে নেবে। একপর্যায়ে আপনার আলোচনার কোনো ফলাফল না-ও আসতে পারে। কিন্তু সে যত প্যাঁচাবে বুঝতে পারবেন, তার বিশ্বাসের জায়গাটা তত দুর্বল।
আপনার এতে খুব কষ্ট পাওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সন্তানই তার পিতা-মাতাকে বিশ্বাস করে না। যদি কোনো মা-বাবা নিশ্চিত হন যে তার ছেলেমেয়েরা তাকে বিশ্বাস করে এবং সেটা আসলেই সত্যি, দয়া করে আমাকে একটু জানাবেন। আমি একবেলা আপনাদের সঙ্গে চা খেতে যাব। কী ভীষণ নিষ্ঠায় আপনি তাদের গড়ে তুলেছেন, সেটা শিখতে যাব।
দুই.
ওপরের অংশটুকু পড়ে যারা মনে কষ্ট পেয়েছিলেন, তারা আরেকটু বাইরে যান। দেখুন তো, আপনার বাচ্চাটি কিংবা তার বন্ধুরা তাদের শিক্ষককে বিশ্বাস করে কি না? সে তার প্রিন্সিপালকে বিশ্বাস করে কি না? সে টিভিতে যা দেখে, সেটাকে বিশ্বাস করে কি না? সে যে আর্টিকেলটা পড়ে, বই পড়ে, বক্তৃতা শোনে, সেগুলো বিশ্বাস করে কি না? সে কি রাস্তার ওপারের দোকানিকে বিশ্বাস করে? সে গাড়ির ড্রাইভার কিংবা রিকশাচালককে বিশ্বাস করে?
কিশোর কথা থেকে এবার আরেকটু ওপরে যাই। যারা কর্মে যোগ দিয়েছেন কিংবা ব্যবসা করছেন, ঘর থেকে বের হয়ে যখন রাস্তায় ভিক্ষুক দেখেন; তখন কি আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন লোকটির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না বলে সাহায্য চাইছে, নাকি আপনি ভাবেন সে আপনাকে বোকা বানাচ্ছে? অফিসের বস কিছু বললে সেটা বিশ্বাস করেন? সহকর্মী কিছু বললে? কিংবা বেতন আটকে গেছে, তখন কি ভাবতে শুরু করেন এই বুঝি টাকাটা মার গেল? নাকি ভাবেন, না, একদিন পাব- এটা সাময়িক। আপনার ব্রেন কীভাবে কাজ করে?
কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে দোকানে গিয়েছেন বাজার করতে। নিউমার্কেট কিংবা গাউছিয়া, নয়তো অন্য কোথাও। আপনার কি প্রতিনিয়ত মনে হয়, লোকটি আপনাকে ঠকাতে পারে? নাকি এটা আপনার ব্রেনের ভেতর এমনভাবে বসে গেছে, সেটা হয়তো এখন আর অনুভবই করেন না। এটাকেই স্বাভাবিক মেনে নিয়েছে আপনার ব্রেন?
আপনি সমাজের কাকে বিশ্বাস করেন? একজন ডাক্তার? প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ- এমন কোনো দলবদ্ধ গোষ্ঠী কি আছে, যাকে আপনি সামাজিকভাবে বিশ্বাস করেন? ব্যক্তিগতভাবে আপনি হয়তো একে তাকে বিশ্বাস করেন। আমি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা বলছি না। আমি সামাজিক বিশ্বাসের কথা বলছি। যারা দেশের বাইরে গিয়েছেন, তারা হয়তো অনেকটা বুঝতে পারবেন। যেমন একটু কলকাতা গিয়ে শপিং করতে গেলে কিংবা ট্যাক্সিতে উঠলে যেমনটা ব্রেন কাজ করে, একই রকম কি কাজ করে সিঙ্গাপুর গেলে? ব্যাংকক কি একটু ভিন্ন? জাপান? মালয়েশিয়া? চীন? প্রতিটা জাতি কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভিন্ন। আমরাও তাই। এ দেশে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এটাই সত্যি। জাস্ট অ্যাকসেপ্ট ইট!
তিন.
বাংলাদেশের মানুষ কেন একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করে না, সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। অনেক যুক্তিতর্ক থাকতে পারে। আমি নিশ্চিত, আমরা সবাই প্রথমেই অনেক কারণ সামনে এনে এটাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে সত্যিটা মেনে নিই যে, হ্যাঁ, আমরা কাউকেই বিশ্বাস করি না।
বাংলাদেশ কিন্তু এমন ছিল না। গত শতকেও বাংলাদেশের মানুষ একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করত। তখন আমাদের অর্থনৈতিক সমক্ষতা আরো দুর্বল ছিল। অর্থনীতি ছোট ছিল। আমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছি, কিন্তু একই সঙ্গে আমরা অবিশ্বাসী জাতিতে পরিণত হয়েছি।
দুই দশক আগেও মানুষ যদি এসে বলত, আমি খেতে পাইনি- অন্যরা সেটা বিশ্বাস করত। তাকে খাবার দিত। এখন থেকে চার দশক আগে গ্রামে একটু অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর বৈঠকঘর (কিছু কিছু জায়গায় বাহির ঘর, কিংবা মজলিশ ঘর) থাকত, যেখানে পথচারীরা এসে চলতি পথে ঘুমাতে পারতেন (সঙ্গে খাবার তো পেতেনই)। কেউ মনে মনে ভাবত না, লোকটি কিছু চুরি করে নিয়ে যাবে। পথচারী রাত্রি যাপন করে নিজের মতো আবার চলে যেতেন।
আমি যখন আমার আশপাশের মানুষকে বিষয়টা বলি, তারা বেশির ভাগই বলে, চারপাশে এত অনিয়ম দেখে আমাদের বিশ্বাস উঠে গেছে। তার অর্থ হলো, তারা জানে তাদের বিশ্বাস উঠে গেছে। একটি জাতির নতুন প্রজন্ম যখন বলে, তাদের বিশ্বাস উঠে গেছে- তার পরিণতি কী, কেউ জানেন?
একটি দেশের বেশির ভাগ মানুষের ব্রেন যখন ‘অবিশ্বাস’ লজিক নিয়ে কাজ করে, তখন সেখানে জীবনযাপনটা কেমন হয়? আপনি দিনটা শুরু করেন কী দিয়ে, আর শেষ করেন কী দিয়ে?
চার.
একটি সমাজ বিগত ৩০-৪০ বছরে অবিশ্বাসী হয়ে উঠল, এটা কেউ থামাতে পারল না? আমরা সবাই হয়তো একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকব! লেখকরা সমাজবিজ্ঞানী নন। তাদের কাছে সমাধান থাকে না। তারা তাদের অবজারভেশনটুকু দিতে পারেন। সামধান খোঁজেন সমাজবিজ্ঞানী কিংবা রাজনীতিবিদরা। হয়তো তাদের কাছে কোনো সমাধান আছে। তারা হয়তো বলবেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, সেই একদিনটা কবে?
আমার ধারণা, আমরা যারা বলি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, তারা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। তারাই সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস তৈরি করছে সমাজে। যে কিশোরটি ক্লাস সিক্সে পড়ে, সে শিখল, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। সে যখন ২০ বছর পর পুরো যুবক, তখনো শুনছে- একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে এটা হয়েছে বেশি। আমরা লেখকরা যেমন মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছি, রাজনীতিবিদরা তো দেখিয়েছেন বটেই! এরপর স্বপ্নের কথা কেউ লিখলে দয়া করে লিখে দেবেন, কত দিন পর সেটা হবে! আর সেটা না জানলে শুধু শুধু বলবেন না- একদিন…! তাহলে অন্তত স্বপ্নভঙ্গ আর অবিশ্বাস তৈরি হবে না। যদি বলেন, একদিন খাবারে ভেজাল থাকবে না, তাহলে বলবেন কোন সাল থেকে ভেজালটা থাকবে না। সেই সালে আপনার সঙ্গে কথা হবে!
বিশ্বাসহীন একটি সমাজের সবচেয়ে বড় বিপত্তি হলো ব্রেন পাওয়ার। তাদের ব্রেন ভিন্নভাবে কাজ করে। তাদের লজিক ভিন্ন হয়, তাদের চিন্তা ভিন্ন হয়, তাদের কর্মকাণ্ড ভিন্ন হয়। আর যে সমাজ একে অপরকে বিশ্বাস করে, তাদের ব্রেন আবার ভিন্নভাবে কাজ করে। শুধু আপনার বুঝতে হবে, আপনি কোথায় বিলং করেন!