অগ্রসর রিপোর্ট : ব্যাংক থেকে কোটিপতি আমানতকারীরা টাকা তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। গত চার মাসে অন্তত ৪ হাজার কোটিপতি ব্যাংক থেকে তাদের টাকা তুলে নিয়েছেন। শুধু সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ৫১৯ জন কোটিপতি আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্য নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার ৩৯৬ জন। জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে আরও প্রায় ৩ হাজার নতুন কোটিপতি এই তালিকায় যুক্ত হন। কিন্তু, ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থেকে এই সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমতে থাকে। ৩০ সেপ্টেম্বর কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৭৯ হাজার ৮৭৭ জন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় কোটিপতিদের অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে পাচার করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে কোটিপতিদের অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন। সেই টাকা তারা ডলারে রূপান্তর করে সম্ভবত বিদেশে পাচার করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জায়েদ বখত বলেন, সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার সময় অনেকেরই ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়েছে। তখন কোটিপতিদের অনেকেই ভয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাইরে পাচার করেছেন। ওই টাকা যে পাচার হয়েছে তার কারণ হলো, সেই সময় ডলারের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্নীতিবিরোধী তথা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় কোটিপতিদের অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। এছাড়া অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও বিদেশে পালিয়ে গেছেন। ফলে আমানতকারীদের মধ্যে ভয় তার টাকা ফেরত পাবেন কিনা। এমন আশঙ্কাতেও ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা তুলেছেন। আবার জাতীয় সংসদে খেলাপিদের মতোই কোটিপতি আমানতকারীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেও অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, ডিসেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদনে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা আরও কমে আসবে। ডিসেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ হবে আগামী মে মাসের দিকে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদন প্রতি তিন মাস পর পর তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগে প্রত্যেক মাসে এক হাজারের বেশি মানুষ নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লেখাচ্ছিল। সেপ্টেম্বরের পর থেকে হঠাৎ এর ছন্দপতন হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছিল ৪ হাজার ১১০ জন। মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭৬ হাজার ২৮৬ জন। জুন শেষে এই সংখ্যা হয় ৮০ হাজার ৩৯৬ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী কমলেও বিগত ১০ বছর ধরে এই তালিকায় কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৯ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৪৯২ জন। এখন এই সংখ্যা ৭৯ হাজার ৮৭৭ জন। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ৫৮ হাজার ৩৮৫ জন মানুষ কোটিপতির তালিকায় নতুন করে নাম লেখিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৬২ হাজার ৩৮ জন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এই সংখ্যা ছিল ৬৭ হাজার ৮৭২ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি রয়েছেন এক হাজার ২২১ জন। তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন শেষে এই সংখ্যা ছিল এক হাজার ২৩৮ জন। ব্যাংকে এক কোটি টাকা আমানত রাখা ব্যক্তি ৬২ হাজার ৯৬৩ জন। জুন শেষে এই সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৪৮১ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ৪০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি রয়েছেন ৩৭১ জন। ৩৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ২৪২ জন। ৩০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ৩৪৪ জন। ২৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৫১৯ জন। ২০ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৯৫৩ জন। ১৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ১ হাজার ৩২৬ জন। ১০ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ২ হাজার ৯৮৬ জন। পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৮ হাজার ৯৫২ জন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি ছিলেন মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৯৪৩ জন। ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতি ছিলেন দুই হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ১৬২ জনে। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে। ২০০৮ সালে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন।