স্টাফ রিপোর্টার: ‘নৌকা চলে পদ্মায়। পদ্মা তো কখনো শুকায় না। কবে এই নদীর সৃষ্টি হইয়াছে কে জানে। সমুদ্রগামী জলপ্রবাহের আজও মুহূর্তের বিরাম নাই। গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনো দিন দেখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে।’
কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গোপন পদ্মার জলে’ দাঁড়াবে ৪২টি পিলার। সেগুলোর উপর দিয়ে দ্বিতল পদ্মা সেতুর কংক্রিট আর স্টিলের কাঠামো টানা হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। উপরের তলায় চার লেনের সড়ক এবং নিচের তলায় ট্রেন লাইন। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষ দিকে গাড়ি চলবে পদ্মার বুকে।
এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের এক-চতুর্থাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের।
দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, ‘যে গতিতে কাজ এগুচ্ছে তাতে ঠিক সময়েই কাজ শেষ হবে আশা করি। অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা কারিগরি কোনো সমস্যা না হলে পদ্মা সেতু নির্ধারিত সময়েই শেষ করা সম্ভব হবে।’
জাজিরার ফকিরকান্দি এলাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৪২টি পিলারের প্রত্যেকটির নিচে ৬টি হিসেবে মোট ২৫২টি পাইল বসবে। এ ছাড়া দুই পাশের সংযোগ সড়কের জন্য স্থাপিত দু’টি পিলারের গোড়ায় বসবে আর ১২টি পাইল। এ সব পাইল বসানোর জন্য হাজার টন ওজনের একটি বিশেষ হ্যামার আনা হয়েছে।
সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকের ফাস্ট প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী নিজের আগ্রহ থেকে এই প্রকল্পের খোঁজ-খবর নেন বলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছি। তাই এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী যে, সঠিক সময়েই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারব আমরা।’
পদ্মা সেতুর কাজ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এমন আগ্রহের বিষয়টি বোঝা যায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তার দেওয়া বক্তৃতার মাধ্যমেও। আর এই কাজ বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর অগণিতবার তিনি পদ্মার পাড়ে ছুটে এসেছেন। সেতু সম্পর্কিত সবকিছুর দেখভাল করছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে।
বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীর প্রকল্প পরিদর্শনে যাওয়ার বিষয়ে মাওয়া ঘাটের চা দোকানদার সোহরাব আলীর কথা, এত ঘন ঘন কোনো মন্ত্রী আসতে আগে দেখিনি। মনে হয় এইটাই মন্ত্রীর অফিস।
শুধু রাজনৈতিক নেতাদেরই নয়। পদ্মার কর্মযজ্ঞে আমলাদেরও সর্বোচ্চ গুরুত্বের বিষয়টি বোঝা যায় গত ১৭ অক্টোবরে সচিব কমিটির বৈঠকের মধ্য দিয়ে। ওইদিন ঢাকা থেকে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার নেতৃত্বে সচিবরা পদ্মা সেতুর কার্যক্রম পরিদর্শন করে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সেতু এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জাদুঘর, পর্যটনের জন্য ইকোপার্ক, আলাদা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেন তারা।
পদ্মা সেতু নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ নিঃসন্দেহে নদীর এপারে থাকা মানুষদের। শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কাজীরহাট বাজারে কথা হয় নূর হোসেনের সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী নূর দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর কথা শুনতে শুনতে অর্ধেক বয়স চলে গেছে। এখন যেভাবে কাজ চলছে তাতে আশা জাগছে। এইবার মনে হয় সেতু হয়েই যাবে।’
পাশে থাকা সাদেক মিয়া নূর হোসেনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জানালেন, ‘শেখের বেটি যে কথা কয়েছিল সেই কথা রাইখপে। নাইলে এই সেতু হতি আরও সময় লাগত।’
২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে পাস হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প। এরপর দুই দফা সংশোধিত হয়ে এর সর্বশেষ কলেবর দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশীয় অর্থায়নে পরিচালিত সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। অবকাঠামোর দিক দিয়ে দেশসেরা প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু।