জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরই শীত এলেই রাজধানীতে গ্যাসের সঙ্কট বাড়ে। কিন্তু, এবার এ সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। দিনের বেলা তো বটেই, রাজধানীর অনেক এলাকায় রাতেও গ্যাসের চুলা জ্বলে না। ফলে গৃহিণীদের দুর্ভোগের সীমা নেই।
সূত্রটি জানায়, দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এর বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ২ হাজার ৭শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ৬ বছরে বর্তমান সরকার গ্যাসের উৎপাদন প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট বাড়ালেও সে তুলনায় আবাসিক, শিল্প ও ক্যাপ্টিভ বিদ্যুৎসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সংযোগ বেশি দিয়েছে। সম্প্রতি প্রায় সাড়ে তিন শ’ শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগ দিয়েছে সরকার। কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালু হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর অপেক্ষায় আছে। ফলে গ্যাস সঙ্কট বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আরও অন্তত ২ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ ও নতুন লোড বৃদ্ধির অপেক্ষায় আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়তি গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ, গ্যাস উৎপাদনে তেমন অগ্রগতি নেই সরকারের। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, তিতাস গ্যাস ফিল্ডে গ্যাস উদগিরণ নিয়ন্ত্রণ, মূল্যায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন হয়নি গত ৬ বছরে। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুন মাসের মধ্যে এই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় আরও দুই বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করার জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। অথচ এ প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে তিতাসের ১৭ ও ১৮নং কূপ খনন ও ত্রি-মাত্রিক ভূকম্পন জরিপ ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন করে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। এতে করে দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাসের চাহিদা পূরণ হতো এবং তিতাস ফিল্ডের স্ট্রাকচারে প্রকৃত অবস্থা ও বিস্তৃতি নিরূপণ করা যেত বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উৎপাদনের সঙ্গে সরবরাহের চাহিদা বেশি থাকায় গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে গ্যাসের এ সংকট আরও তীব্র হবে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম। তিনি দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সাপ্লাইয়ের সঙ্গে ডিমান্ডের সামঞ্জস্য যদি না থাকে এবং অপরিকল্পিতভাবে যদি ডিমান্ড বাড়ানো হয় তাহলে গ্যাসের সঙ্কট হবে, এটাই স্বাভাবিক।’
ড. শামসুল আলম বলেন, শীতকালে গ্যাসের চাপ থাকে নানা কারণে। কিন্তু, সেটা মোকাবিলার জন্য কোনো কৌশল নেই। অতীতের বিচার বিশ্লেষণ কখনো কাজে লাগায়নি কর্তৃপক্ষ। লাইন মেইনটেইন্স হয় না যথাসময়ে। বলা হয়ে থাকে-লাইন পুরোনো। কিন্তু, এটা তো হবেই। লাইনের রিপ্লেসমেন্ট হবে না? এটা অজুহাত হতে পারে না। এসব সমস্যা তো অবশম্ভাবী নয়। সজাগ থাকলে, সচেষ্ট থাকলে এবং বন্টন বিতরণের মধ্যে ভারসাম্য থাকলে এসব সমস্যা আর হবে না।’
জাতীয় গ্যাস গ্রিড পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। গ্যাসের সঞ্চালন লাইন পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও তাদের। অন্যদিকে রাজধানী ও এর আশপাশের গ্যাসের বিতরণ লাইন পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব টিজিটিডিসিএল-এর।
জিটিসিএল ও টিজিটিডিসিএল সূত্রে জানা যায়, শীতে গ্যাসের পাইপলাইনে কনডেনসেট জমে পাইপের প্রকৃত ব্যাস কমে যায়। অনেক এলাকায় চাহিদার বিপরীতে পাইপের ব্যাস ছোট। অপেক্ষাকৃত সরু পাইপে অন্য সময় গ্যাসের চাপ মোটামুটি ঠিক থাকলেও এই শীতে তা অনেক কমে গেছে। বর্তমান সঙ্কটের ক্ষেত্রে বাখরাবাদ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইন নিষ্ক্রিয় থাকার পাশাপাশি এটিও একটি বড় কারণ। তাই ধীরে ধীরে বিতরণ লাইনের এ সরু পাইপের জায়গায় মোটা পাইপলাইন বসাতে হবে। তা না হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচ এম আলী আশরাফ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ ট্রান্সমিশন লাইন ৩০ ইঞ্চি। এখানে কিছু ডাস্ট (ময়লা) আসছিল। এটা আমরা ফাইন্ড-আউট করেছি। দুপুর একটার পর থেকে প্রেসার শুরু হবে। আশা করা যায় বিকেল থেকে রেজাল্ট আসবে। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই সঙ্কটের তীব্রতা কমতে শুরু করবে। তবে পুরো সঙ্কট কাটতে আরও সময় লাগবে’ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘তিতাসের সরবরাহ এলাকায় প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সবগুলো সার কারখানা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র চলমান থাকায় চাহিদার পুরোটা গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।’
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপরাশেন ও মাইন্স) জামিল আহমেদ আলীম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শীতকালে মানুষের গ্যাসের চাহিদা বাড়ে। পানি গরমসহ বিভিন্ন কাজে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন মানুষ। এরপরে আমাদের একটি লাইন সমস্যা হয়েছিল। এখন ঠিক হয়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে, ঢাকাতেও স্বাভাবিক হবে। প্রতিদিনই ইমপ্রুভ হচ্ছে। আশা করি অচিরেই সমাধান হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যাসের ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই কম, এটা তো জানেনই। সুতরাং কখনো চাহিদা বাড়লে সিস্টেমে চাপ পড়ে বেশি। শীতকালে উৎপাদন কম হয় না। আগেও যা ছিল এখনো তাই আছে। দুই হাজার সাত শ’ ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে দুই হাজার সাত শ’ ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এদিন দুই হাজার ৬৩৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়েছে।’
এদিকে গ্যাসের এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘গ্যাস সঙ্কট থেকে দ্রুত উত্তরণের উপায় নেই। সরকার নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের পাশাপাশি বিদেশ থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এখন নতুন করে উৎপাদিত গ্যাস এবং আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে শিল্পে গ্যাস-সঙ্কট মেটানোর চেষ্টা চলছে।’
আবাসিক গ্যাস সঙ্কট থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ আবাসিক গ্রাহককে বোতলজাত সিলিন্ডার গ্যাস বা এলপিজি ব্যবহারের দিকে যেতে হবে। পাইপলাইনে আর গ্যাস পাওয়া যাবে না।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘তবে শীত কিছুটা কমলে এবং বাখরাবাদ-সিদ্ধিরগঞ্জ পাইপলাইনের সংস্কারকাজ শেষ হলে রাজধানীর গ্যাস সঙ্কট কিছুটা কমে আসবে।’