অগ্রসর রিপোর্ট : সকালের প্রথম সূর্যকিরণ ছোঁয়ার পরপরই রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের আয়োজিত বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান। সুর আর সংগীতে বরণ করে নেওয়া হয় বাংলা ১৪৩২ সনকে।
ভোর সোয়া ছয়টার দিকে শিল্পী সুপ্রিয়া দাশের কণ্ঠে ভৈরবী রাগালাপ দিয়ে শুভ সূচনা হয় পহেলা বৈশাখের এই আয়োজনে।
অনুষ্ঠান শুরুর আগেই অসংখ্য মানুষ সেখানে এসে জড়ো হন। সময় গড়ানোর সাথে সাথে উপস্থিতির ভিড় আরও বেড়ে যায়। এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ছায়ানট তুলে ধরতে চেয়েছে—আশা, সহনশীলতা ও নবজাগরণের বার্তা।
আয়োজনে গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয় ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নিহতদের স্মরণে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, আগতদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের ছাপ। নারীদের বেশিরভাগই শাড়িতে সজ্জিত, আর পুরুষদের শরীরে ছিল বাহারি রঙের পাঞ্জাবি। পোশাকে রঙের বৈচিত্র্য থাকলেও লাল-সাদার আধিপত্য ছিল বিশেষভাবে নজরকাড়া।
গান ও কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয় নতুন বাংলা বছরকে। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন প্রতিটি পরিবেশনা। বর্ষবরণের সুরের আবেশে কেউ কেউ গানের সাথে আপন মনে ঠোঁট মেলান। অনেকেই দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। প্রতিটি পরিবেশনার শেষে ছিল করতালির উষ্ণ প্রতিধ্বনি। নতুন বছরটি যেন আনন্দময় হয়—এমন কামনাই সবার মুখে মুখে।
অনুষ্ঠানস্থলে কথা হয় প্রবাসী ফাতেমা খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমি লন্ডনে থাকি। বহুদিন পর দেশে ফিরেছি। গ্রামে যাওয়া হলেও রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখার জন্য রাতেই ঢাকায় চলে আসি। এখানে এসে অসাধারণ লাগছে।”
ছায়ানটের এ আয়োজনে পুনরায় গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রাণ হারানোদের স্মরণ করা হয়। সকাল সাড়ে আটটার দিকে অনুষ্ঠান সমাপ্তির আগে শিল্পী ও দর্শনার্থীরা সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
পরিশেষে ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এ বছরের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
এ সময় ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, “বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার এই আয়োজন আমাদের এক আলোকোজ্জ্বল, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখায়, যেখানে বিভাজন নয়—সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠবে।”
তিনি আরও বলেন, “নববর্ষের এই প্রভাত লগ্নে আমরা ফিরে তাকাই আত্মজিজ্ঞাসার খাতায়। একদিকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে বিরূপতা, বিভাজন, নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা। এই ব্যর্থতাগুলোর দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজও দায়মুক্ত নয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রেখে, মুক্ত চিন্তাকে সাহসের সঙ্গে ধারণ করে, আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে সুনিশ্চিতভাবে এগিয়ে নিতে পারব।”
গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে গাজায় যেভাবে গণহত্যা চালানো হচ্ছে—বিশেষত শিশুদের হত্যা—তা আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আমাদের পূর্ণ সংহতি রয়েছে।”
তিনি সকলকে আহ্বান জানান গাজায় শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনে।
ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ বরণের এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে। পাশাপাশি একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলেও অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট নিয়মিতভাবে রমনার এই ঐতিহাসিক বটমূলেই বাংলা নববর্ষের আয়োজন করে আসছে।