ভোটার হওয়া ও প্রেসিডেন্ট পদে লড়বার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা:
ভারতের পর আমেরিকা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছরে একবার। প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালও চার বছর। নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার ধার্য করা আছে ইলেকশনের দিন। তাই যুগ যুগ ধরে একটুও নড়চড় হয় না নির্বাচনের দিনক্ষণের। আগের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চলাকালেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যবস্থা নেই সেখানে। যদি কেউ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হতে হবে এবং কমপক্ষে ১৪ বছর আমেরিকায় অবস্থান করতে হবে। প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর। আমেরিকার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন এফ ক্যানেডি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
এছাড়া কেউ দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন না। অর্থাৎ ওবামা, জর্জবুশ কিংবা বিল ক্লিনটন কেউই আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার যোগ্য নন। মূলত আমেরিকার স্থপতি এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নিমিত্তে এই আইনটি করা হয়েছে। তিনি পরপর দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ইচ্ছে করেই তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেননি।
১৮ বছর বয়সের উপরে যেকোন মার্কিন নাগরিক ভোট দিতে পারবেন। ভোটের দিন কোন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় না। তাই নাগরিকদের নিজ দায়িত্বে সময় বের করে ভোট দিয়ে আসতে হয়। তবে এই ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক দেখা গেছে সাম্প্রতিক কালের অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে। ২০১৪ সালের এই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল মাত্র ৩৪.৪%।
যেভাবে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট:
নাগরিকদের সরাসরি ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। বরং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি হলো পরোক্ষ। প্রথমে জনগণ ভোট দিয়ে ইলেক্ট্রোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচিত করেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য ব্যালট পেপারে কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নাম লেখা থাকে। আর একেক রাজ্যের নিয়ম অনুসারে নির্বাচক মণ্ডলীর নাম উল্লেখ্য থাকতেও পারে নাও পারে। জনগণ কোন নির্দিষ্ট প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অর্থ হল তার দলের নির্বাচকমণ্ডলীর মনোনীত করা। পরবর্তীতে সেই নির্বাচকমণ্ডলী ভোট দিয়ে নির্বাচন করেন জনগণের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে। তবে ফেডারেল আইন অনুসারে নির্বাচকমণ্ডলী কিন্তু জনগণের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য নন। অর্থাৎ নির্বাচক মণ্ডলী চাইলেও দলের বাইরে গিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। তবে ৫০টি রাজ্যের মধ্যে ২৪টি রাজ্যের আইনে এই ধরণের “বিশ্বাসঘাতকতা” অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। আর বর্তমান যুগে সচরাচর কোন নির্বাচককে নিজ দলীয় প্রার্থীর বাইরে অন্য কাউকে ভোট দিতে দেখা যায়না। তাই বলা যায় জনগণ যে প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থীর নির্বাচকমণ্ডলীদের ভোট দেবে তিনিই ঐ রাজ্যের সবগুলো ইলেক্ট্রোরাল ভোট পেয়ে যাবেন।
রাজ্য অনুসারে ইলেক্ট্রোরাল ভোট সংখ্যা:
যেমন ধরুন, এবারের ইলেকশনে টেক্সাস রাজ্যে হিলারির ক্লিনটনের পক্ষে অধিকাংশ জনগণ ভোট দিল। টেক্সাসের জন্য বরাদ্দকৃত ইলেক্ট্রোরাল ভোটের সংখ্যা ৩৮। এর মানে দাঁড়াল জনগণ ডেমোক্র্যাট দলের নির্বাচক মণ্ডলীদের হিলারিকে ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করল এবং হিলারি টেক্সাসের ঐ ৩৮ টি ইলেক্ট্রোরাল ভোটের সবগুলো একাই পাবেন যদি নির্বাচকমণ্ডলীর কেউ বিশ্বাসঘতকতা না করেন। আরেকটি ব্যাপার এখানে লক্ষণীয় সেটা হল একজন প্রার্থী কোন একটি স্টেইট থেকে হয় সবগুলো ইলেক্ট্রোরাল ভোট আর না হয় কোন ইলেক্ট্রোরাল ভোটই পাবেন না। তাই অধিকাংশ জনগণের ভোট পেয়েও ইলেক্ট্রোরাল ভোট কম পাওয়ার কারণে হেরে যাওয়ার ঘটনা বেশ কয়েকবারই ঘটেছে মার্কিন ইতিহাসে। ২০০০ সালের ইলেকশনে শেষবার ঘটেছিল এমন ঘটনা। সেবার জর্জ ডাব্লিউ বুশ মেজরিটি ভোট পাননি ঠিকই কিন্তু পেয়েছিলেন ২৭১ টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাল গোর অধিকাংশ পপুলার ভোট পেয়েও ইলেক্ট্রোরাল ভোটের চক্করে পড়ে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন ২৬৬ টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট। তবে শুধু নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যে বিজয়ী প্রার্থী সব ইলেক্ট্রোরাল ভোট একাই পান না, বরং সেটা পপুলার ভোট বিজয়ী ও কংগ্রেশনাল জেলায় বিজয়ী প্রার্থীর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। জটিলতা এড়াতে আরও বিস্তারিত বিবরণে যাচ্ছিনা।
প্রতিটি রাজ্যে বরাদ্দকৃত ইলেক্ট্রোরাল ভোটের সংখ্যা সেই রাজ্যে জনপ্রতিনিধি ও সিনেটরের সংখ্যার সমান থাকে। গোটা আমেরিকায় মোট ইলেক্ট্রোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮টি যার মধ্যে শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতেই রয়েছে সর্বোচ্চ ৫৫টি। আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে চাইলে একজন প্রার্থীকে অবশ্যই কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট পেতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে একক কোন নির্বাচন না বলে বরং ৫০ টি রাজ্য ও একটি জেলায় (কলাম্বিয়া) আলাদা আলাদা নির্বাচনের সম্মিলন বললেও ভুল হবেনা। কারণ প্রতিটি রাজ্য থেকে নির্বাচিত নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট। যদিও নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচিত হন নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারা নিজ নিজ স্টেইটের রাজধানীতে এসে প্রেসিডেন্টকে ভোট দিয়ে যান ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।
কেন নির্বাচন প্রক্রিয়াটি এত জটিল?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই জটিল প্রক্রিয়াটি পড়ার পর একটি প্রশ্ন স্বভাবতই মনে চলে আসার কথা যদি জনসমর্থনের কাছে নির্বাচকমণ্ডলীর হাত পা বাঁধা থাকে তাহলে খামোখা নির্বাচকমণ্ডলীদের দিয়ে পরোক্ষ নির্বাচন করিয়ে লাভ কি? এর চেয়ে বরং সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেই তো হয়।
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আমেরিকার সংবিধানে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেন না ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সেটি একক কোন দেশ ছিল না বরং সেটা ছিল অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্যের একটি সমন্বিত জোট। তাই এখনও আমরা দেখতে পাই আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যের আইন পরস্পরের চেয়ে কতটা আলাদা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। সে যাই হোক আমেরিকার গোড়া পত্তনের সময় নিউজার্সির মত ছোট ছোট রাজ্যগুলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভার্জিনিয়া কিংবা নিউইয়র্কের মত জনবহুল রাষ্ট্রগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের ভয়ে প্রচলিত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পথে যেতে চায়নি। তাই জাতীয় নির্বাচনে ছোট বড় সব রাজ্যের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতেই এই ইলেক্ট্রোরাল কলেজ ব্যবস্থার অবতারণা। এছাড়া আম জনগণ সরাসরি ভোট দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং মানের চেয়ে সংখ্যার আধিপত্যে প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে এইসব আশঙ্কায় মার্কিন জাতির জনকরা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বদলে পরোক্ষ গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও অতীতে অনেকবারই এই ব্যবস্থা বাতিলের দাবি উঠেছে এবং আদালত চলেছে অনেক তর্ক বিতর্ক, এখন অবধি পূর্ব পুরুষদের করা এই নিয়ম টিকে আছে মার্কিন মুল্লুকে।
হিলারি নাকি ট্রাম্প কে পেতে যাচ্ছেন মেজরিটি ইলেক্ট্রোরাল ভোট? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই জানা যাবে কে হবেন হোয়াইট হাউসের পরবর্তী বাসিন্দা। তবে ট্রাম্প বা হিলারি যেই প্রেসিডেন্ট হউন না কেন সারা বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন হাতে করে নিয়ে আসেন শান্তির পায়রা। আর সংঘাত নয় যেন যুদ্ধে জর্জরিত এই ধরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তার দূরদর্শিতায়।