অগ্রসর রিপোর্টঃ জাতীয় পার্টির নেতা ও যশোরের সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদন্ড এবং অপর আরো ৭ রাজাকারকে আমৃত্যু কারাদন্ড দিয়ে একটি যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় ঘোষণা করে।
৮ আসামীর বিরুদ্ধে ৭৬৮ পৃষ্ঠা রায়ের সংক্ষিপ্তসার ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। রায়ে বলা হয়, আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ নির্য়াতনের সবকটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে।
প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, দেরীতে হলেও নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ, নির্যাতনকে স্বাধীনতাকামীদের দমনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রায় বিচারের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।
প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ১৪ জুলাই মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রেখে (সিএভি) আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আজ রায় ঘোষণার দিন গতকাল ধার্য করে দেয় ট্রাইব্যুনাল। আট আসামির মধ্যে গ্রেফতার সাখাওয়াত ও মো. বিল্লাল হোসেন বিশ্বাসকে রায় ঘোষণা উপলক্ষে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এছাড়া অপর ছয় আসামি মো. ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম এবং মো. আব্দুল খালেক পলাতক রয়েছে। এ মামলায় অভিযুক্ত আরেক আসামি মো. লুৎফর মোড়ল কারাবন্দি থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আনা সাখাওয়াতসহ ৮ রাজাকারের মামলার রায় হলো ২৬ তম রায়।
উল্লেখ্য-গত বছরের ২৬ জুলাই সাখাওয়াতসহ যশোরের কেশবপুরের ১২ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন । পরে ৮ সেপ্টেম্বর তিনজনকে অব্যাহতি দিয়ে নয়জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ জুন পর্যন্ত আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১৬ জন সাক্ষী। আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী ছিলো না। একই মামলার আসামি ৮ রাজাকারের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ আশ্বিন সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে চিংড়া বাজার রাজাকার ক্যাম্পের (তহসিল অফিস) কমান্ডার সাখাওয়াত হোসেনের নির্দেশে ১০ থেকে ১২ জন রাজাকার কেশবপুর থানার বগা গ্রামের আশুরা খাতুনকে জোর করে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং ধর্ষণ করে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৮ আশ্বিন আনুমানিক ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে কেশবপুর থানার ২নং সাগরদাড়ি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদ চাদতুল্য গাজীকে সাখাওয়াতসহ ২৫ থেকে ৩০ জন রাজাকার ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে চার দিন আটক রেখে নির্যাতন করে পহেলা কার্তিক গুলি করে হত্যা করে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ওই একই তারিখে চিংড়া গ্রামের নুর উদ্দিন মোড়লকে ধরে নিয়ে সাখাওয়াতের নির্দেশে নির্যাতন করা হয়।
চতুর্থ অভিযোগ বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের আশ্বিন মাসের শেষ দিকে এক রাত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স কেশবপুর থানা হিজলডাঙ্গা গ্রামের মালেক সরদারকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে ২৮ আশ্বিন সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে চিংড়া বাজারে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে আশ্বিন মাসের প্রথম দিকে বেলা ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা মিরোন শেখকে তার বাড়ি থেকে ১০ থেকে ১২ জন রাজাকার ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তিনি পালাতে চাইলে রাজাকারা তাকে গুলি করে। এতে তার বাম হাতে গুলি লাগে। এরপর রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে একই অপরাধে আরো ১১ জনের সম্পৃক্ততা বিষয়টি ওঠে আসে। সাখাওয়াত ১৯৯১ সালে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে জামায়াতের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকাবস্থায়ই তিনি জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুারির নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তিনি। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করে পরাজিত হন সাখাওয়াত। ২০০১ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। পরে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করলে তিনি এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। গত বছরের ২৯ নভেম্বর সাখাওয়াত হোসেনকে রাজধানীর উত্তরখান থেকে আটক করা হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।