ষ্টাফ রিপোর্টার- আগামী ২০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ শতাংশ বাড়বে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে যানবাহনও। এ সময়ের মধ্যে নগরবাসীর দৈনিক যাতায়াত (ট্রিপ) বাড়বে প্রায় ৭১ শতাংশ; যা রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বাড়াবে দ্বিগুণ। পরিস্থিতি উত্তরণে ঢাকায় আগামী ২০ বছরে পাঁচটি মেট্রোরেল চালু করতে হবে। পাশাপাশি দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), নতুন কয়েকটি সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েও নির্মাণ করতে হবে। রাজধানীর যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধন-সংক্রান্ত দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে প্রতিবেদনটি জমা দেয় জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এএলএমইসি করপোরেশন, ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল লিমিটেড ও কাটাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ; যা ২০৩৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৬৩ লাখে। এ সময় ট্রিপের সংখ্যা ২ কোটি ৯৮ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫ কোটি ১১ লাখে। কিন্তু বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থায় এ যাতায়াত সম্ভব নয়। ফলে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তথা মেট্রোরেল ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে হবে। এজন্য বর্তমানে চলমান প্রকল্পসহ রাজধানীতে পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হবে। এতে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে প্রায় ২ হাজার ৫৬ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।
এসটিপি সংশোধনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক মো. কায়কোবাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, রাজধানী ও আশপাশে প্রত্যক্ষ জরিপ, যানবাহন ও সম্ভাব্য ট্রিপের চাহিদার ভিত্তিতে মেট্রোরেলগুলোর প্রস্তাবিত রুট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বড় চ্যালেঞ্জ। তবে জমি অধিগ্রহণও এসটিপি বাস্তবায়নে অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এসটিপি সংশোধনের পর পরই সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণে প্রস্তাব দেয়া হবে।
মেট্রোরেলের পাঁচটি রুটের মধ্যে বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল প্রকল্প চলমান রয়েছে; যা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট-৬ (এমআরটি-৬) নামে পরিচিত। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায় এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে এমআরটি-৬ উত্তরা থেকে আশুলিয়া ও মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মেট্রোরেলটির দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪১ কিলোমিটার। বাড়তি ২১ কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০৯ কোটি ডলার। প্রথম অংশের মতো বর্ধিত অংশও হবে উড়ালপথে (এলিভেটেড)। উত্তরা-মতিঝিল ২০ কিলোমিটার ২০২১ সালের মধ্যে শেষ হলেও বর্ধিত ২১ কিলোমিটার ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্পন্নের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত এমআরটি-১ গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে বিদ্যমান রেলপথ ধরে কমলাপুর হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত যাবে। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশ ২০২৫ সালে ও দ্বিতীয় পর্যায়ে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত ২০৩৫ সাল নাগাদ নির্মাণ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ের দৈর্ঘ্য হবে ২৬ দশমিক ৬ কিলোমিটার; যার ছয় কিলেমিটার হবে মাটির নিচে ও বাকি অংশ উড়ালপথে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের দৈর্ঘ্য হবে ৫২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ৭ কিলোমিটার উড়ালপথে ও ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে নির্মাণ করতে হবে। প্রথম পর্যায়ের জন্য ব্যয় হবে ২৮৩ কোটি ডলার ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫৮৭ কোটি ডলার।
এমআরটি-২-এর সম্ভাব্য রুট হবে আশুলিয়া থেকে শুরু করে সাভার, গাবতলী, মিরপুর রোড হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনের (নগর ভবন) সামনে দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত। পুরোটাই উড়ালপথে প্রস্তাবিত এ মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে ৪০ কিলোমিটার এবং ব্যয় ৩৭৫ কোটি ডলার। এমআরটি-৪ নির্মাণ করতে হবে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। উড়ালপথে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেলটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৪ কোটি ডলার। এমআরটি-৫ হবে অনেকটা রিং মেট্রোরেল। এটি নির্মাণ করতে হবে ভুলতা থেকে বাড্ডা, মিরপুর সড়ক, মিরপুর-১০, গাবতলী বাস টার্মিনাল, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা সিটি (পান্থপথ) হয়ে হাতিরঝিল লিংক রোড পর্যন্ত। এটি মূলত এমআরটি-১, ২, ৪ ও ৬কে যুক্ত করবে। ৩৫ কিলোমিটার এ মেট্রোর ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে ও ২৪ দশমিক ৯ কিলোমিটার উড়ালপথে নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪২৮ কোটি ডলার।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক বলেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তথা মেট্রোরেল ব্যবস্থা উন্নয়নের বিকল্প নেই। জাইকাও বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। এমআরটি-১ প্রকল্পটি নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনাও চলছে। চীনের সঙ্গেও একটি মেট্রোরেল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসটিপি সংশোধনের পর এ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে অন্যান্য দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আশা করা যায়, সম্ভাবনাময় এ খাতে দ্রুত বিনিয়োগ সাড়া পাওয়া যাবে। পাঁচটি এমআরটির বাইরে দুটি বিআরটি নির্মাণে সুপারিশ করা হয়েছে সংশোধিত এসটিপির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। এর মধ্যে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক, মগবাজার, শান্তিনগর, গুলিস্তান হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত হবে বিআরটি-৩। বর্তমানে দুই প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর-বিমানবন্দর সড়ক ও বিমানবন্দর সড়ক-ঝিলমিল অংশের বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রথম অংশের কাজ আগামী বছর শুরুর সম্ভাবনাও রয়েছে। এছাড়া শহরের পূর্বাংশে বিআরটি-৭ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে ইস্টার্ন বাইপাস হয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত যাবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৩৬ কিলোমিটার আর সম্ভাব্য ব্যয় হবে ২৮ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০৩৫ সাল নাগাদ রাজধানীর যানবাহন চাহিদার প্রায় ৬৪ শতাংশ পূরণ করতে পারবে পাঁচটি মেট্রোরেল ও দুটি বিআরটি। এটি মূলত রাজধানী ও আশাপাশের জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করবে। তবে রাজধানীর বাকি ৩৬ শতাংশ যানবাহনের চাহিদা মেটানো ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে দ্রুত সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে বেশকিছু সড়ক উন্নয়ন ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে হবে। এজন্য চার পর্যায়ে ৯৬ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। প্রস্তাবনায় বলা হয়, ঢাকার চারপাশে তিনটি বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ করতে হবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৃত্তাকার সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৭৩ কিলোমিটার, মধ্যবর্তী সড়ক ১০৮ ও রাজধানীর বাইরের বৃত্তাকার সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১২৯ কিলোমিটার। এজন্য মোট ব্যয় হবে ৩৫ হজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার সংযোগ উন্নয়নে ২৯০ কিলোমিটার প্রাইমারি সড়ক ও ৪৭১ কিলোমিটার সেকেন্ডারি সড়ক উন্নয়ন করতে হবে। এতে ব্যয় হবে যথাক্রমে ১০ হাজার ৯৮৪ কোটি ও ১৮ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।
এর বাইরে ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে পূর্ণ বা আংশিকভাবে থাকবে ঢাকায়। ২০ কিলোমিটার ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ শুরু হবে চলতি মাসে। আর ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ, ঢাকা-সিলেট এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ নির্মাণ করতে হবে। সব মিলিয়ে দৈর্ঘ্য হবে ১২৬ কিলোমিটার আর নির্মাণে ব্যয় হবে ৩১ হাজার ৪২ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত. রাজধানী ও আশপাশের জেলা যানজটমুক্ত করতে ২০০৪ সালে প্রণয়ন করা হয় ২০ বছর মেয়াদি এসটিপি। তবে সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে ১০ বছরেই প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে এটি। তাই এসটিপি সংশোধন করা হচ্ছে। জাইকার অর্থায়নে এজন্য কাজ করবে জাপানের তিন প্রতিষ্ঠান। আগামী সেপ্টেম্বরে এর খসড়া প্রতিবেদন জমা দেবে প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ডিসেম্বরে চূড়ান্ত হবে সংশোধিত এসটিপি। এর পরই প্রয়োজন অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশলের বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে জোর দেয়া জরুরি। ২০০৪ সালে এসটিপি প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উল্টো এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ফলে এটি কার্যকারিতা হারিয়েছে। সংশোধিত এসটিপির ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তা না হলে পরিকল্পনার কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। আর ঢাকা ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাবে।