প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান, FRCS (Glasgow)
রসূল মুহাম্মাদ স.-কে অনুসরণ করা সকল মুসলিমের জন্য ফরজ (অবশ্য করণীয়)। আর এ কাজে সফল হওয়া না হওয়ার ওপর নির্ভর করে একজন মুসলিমের দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা ও ব্যর্থতা। কোনো কাজে সফল হতে হলে সে কাজের উদ্দেশ্যটি প্রথমে সঠিকভাবে জানতে হয়। অতঃপর কাজটি করার সময় ঐ উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে কি না বা হবে কি না তা সর্বক্ষণ খেয়াল রাখতে হয়। অন্যদিকে একটি কাজের মাপকাঠি জানা থাকলে তা দিয়ে কাজটি করার সঠিকত্বের দিক দিয়ে নিজে ও অন্যরা কী অবস্থানে আছে তা মাপা যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
বর্তমান বিশ্বের মুসলিমদের জীবন পরিচালনার দিকে তাকালে সহজেই বলা যায়- মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ স.-কে যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সে বিষয়ে তাদের অধিকাংশের জ্ঞান কুরআন, সুন্নাহ ও Common Sense -এর সাথে সংগতিশীল নয়। এর ফলস্বরূপ মুসলিমদের দুনিয়ার জীবনের ব্যর্থতা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর তাদের অধিকাংশের পরকালীন জীবনের অবস্থা কী হবে তা বোঝাও কঠিন নয়।
তাই, ব্যক্তি ও জাতির দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আলোচ্য বিষয়ে কলম ধরা-
মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য জানার গুরুত্ব
উদ্দেশ্য না জেনে কোনো কাজ করলে ব্যর্থতা অনিবার্য। এটি একটি চিরসত্য ও সহজবোধগম্য কথা। তাই, মুহাম্মাদ স.-কে কী উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে তা সঠিকভাবে না জেনে তাঁকে অনুসরণ করলেও ব্যর্থতা অনিবার্য। সুতরাং মুহাম্মাদ স.-কে আল্লাহ তা‘য়ালা কী উদ্দেশ্যে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তা জানা সকল মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
একটি বিষয়। আর যে কোনো কাজের উদ্দেশ্য জানার ব্যাপারে মহাগ্রন্থআল কুরআনের বক্তব্য হলো- আমরা আকাশ, পৃথিবী এবং এ দুটির মধ্যবর্তী কোনো কিছুই বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। এটি কাফিরদের ধারণা। সুতরাং যারা কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ।
(সুরা সোয়াদ/৩৮ : ২৭)
ব্যাখ্যা : এ আয়াতটির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যগুলো মহান আল্লাহ মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন তা হলো- ▪ মহাকাশ, পৃথিবী এবং এ উভয়ের মধ্যে যত জিনিস বা বিষয় আছে তার প্রত্যেকটি সৃষ্টি বা প্রণয়ন করার পেছনে মহান আল্লাহর একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। অর্থাৎ আল্লাহ বলেছেন মানুষ, নবী-রসূল, পশু-পাখি, গাছপালা, নদীনালা, কুরআন, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জ ইত্যাদি সৃষ্টি বা প্রণয়ন করার পেছনে তাঁর একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে।
▪ যারা মনে করে বা ধারণা করে ঐ সকল কিছুর কোনো একটিও মহান আল্লাহ্ বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি বা প্রণয়ন করেছেন তারা কাফির।
▪ পরকালে ঐ কাফিরদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
মহান আল্লাহ্ এখানে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে- মহাকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে থাকা মানুষ, নবী-রসূল, পশু পাখি, গাছপালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, খাবার-দাবার, কুরআন, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জসহ সকল কিছু তৈরি বা প্রণয়ন করার পেছনে তাঁর একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। যারা ধারণা করবে যে, ঐ সকল কিছুর কোনো একটিও মহান আল্লাহ বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি বা প্রণয়ন করেছেন তারা কাফির বলে গণ্য হবে এবং তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম।
এ আয়াত থেকে জানা যায়- মহান আল্লাহ নির্দেশিত ইসলামের কোনো কাজ বা বিষয় পালন করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে হলে প্রথমে সে কাজ বা বিষয়টি কী উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে তা সঠিকভাবে জানতে হবে। তারপর সে উদ্দেশ্য সাধনকে সামনে রেখে কাজটি বা বিষয়টি পালন করতে হবে।
তাই, আয়াতটির আলোকে সহজে বলা যায়- রসূল মুহাম্মাদ স.-কে অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে হলে প্রথমে আল্লাহ তা‘য়ালা কী উদ্দেশ্যে মুহাম্মাদ স.-কে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তা সঠিকভাবে জানতে হবে। তারপর সে উদ্দেশ্য সাধনকে সামনে রেখে তাঁকে অনুসরণ করতে হবে।
এ জন্যে ইসলামী জীবন বিধানে মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে জানার গুরুত্ব অপরিসীম।
মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য
মহান আল্লাহ প্রদত্ত তিনটি উৎস তথা কুরআন, সুন্নাহ (হাদীস) ও Common Sense-এর আলোকে আমরা বিষয়টি জানার চেষ্টা করবো।
মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে Common Sense
বর্তমানে আমরা সকলে জানি যে- একটি কোম্পানি যখন কোনো যন্ত্র তৈরি করে তখন তার পেছনে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে থাকে। আর যন্ত্রটা কোম্পানি যখন বাজারে ছাড়ে তখন যন্ত্রটির মৌলিক দিক তথা যন্ত্রটি তৈরির উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য সাধনের মৌলিক তথ্য ধারণকারী একটি বই (Manual) তার সাথে থাকে। যন্ত্রটি জটিল হলে বিক্রির পর কোম্পানি যন্ত্রটির সাথে শুধু ম্যনুয়াল নয় একজন ইঞ্জিনিয়ারও পাঠায়। ইঞ্জিনিয়ার যন্ত্রটি চালিয়ে ভোক্তাদের দেখিয়ে দেয়। আর যন্ত্রটি পরিচালনা করার মতো যোগ্য লোক ভোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলে ইঞ্জিনিয়ার বিদায় নেন।
সুরা বাকারার ২৬নং আয়াতসহ বিভিন্ন আয়াতে সত্য উদাহরণকে মহান আল্লাহর কাছ থেকে আসা নির্ভুল (সত্য) শিক্ষা বলা হয়েছে। তাই, ওপরে বর্ণিত উদাহরণের ভিত্তিতে Common Sense-এর আলোকে সহজে বলা যায়- ১. মানুষ সৃষ্টির পেছনে অবশ্যই আল্লাহ তা‘য়ালার একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে থাকবে।
২. পৃথিবীতে পাঠানোর সময় মানুষের সাথে তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক তথ্য ধারণকারী গ্রন্থ (Manual) আল্লাহ তা‘য়ালার পাঠানোর কথা।
৩. মানুষ অত্যন্ত জটিল প্রাণী। তাই, দুনিয়ায় মানুষের সাথে শুধু Manual নয়, Manual-এ থাকা বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষও আল্লাহ তা‘য়ালার দুনিয়ায় প্রেরণ করার কথা।
মহান আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানোর সাথে সাথে উপর্যুক্ত শর্তগুলো যথাযথভাবে পূরণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি জটিল যন্ত্রের সাথে গধহঁধষ ও ইঞ্জিনিয়ার পাঠানোর জ্ঞানটি আল্লাহ তা‘য়ালার ঐ কর্মপদ্ধতি থেকেই পেয়েছে।
আল্লাহ তা‘য়ালার পাঠানো ঐ Manual হলো তাঁর প্রেরিত কিতাব। ঐ কিতাবের সর্বশেষ সংস্করণ হলো আল কুরআন। আর আল্লাহ তাঁর প্রেরিত কিতাবে থাকা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং মানব-জীবনের বিভিন্ন দিকের মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবে পালন করে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন নবী-রসুলগণকে। নবী-রসূলগণের প্রথম জন হলেন আদম (আ.) এবং শেষ জন হলেন মুহাম্মাদ স.।
তাই, Common Sense-এর আলোকে সহজে বলা যায়, মুহাম্মাদ স.-কে দুনিয়ায় পাঠানোর কারণ হলো- যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে দেওয়া, যাতে তাঁদের অবর্তমানে দুনিয়ার মানুষ ঐভাবে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে পারে।
আর তাই, মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য বুঝতে হলে যে সকল বিষয় নির্ভুলভাবে জানতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-
১. মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
২. সে উদ্দেশ্য সাধনের উপায়।
মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল কুরআন
এখন আমরা আল কুরআন থেকে ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলো বিশেষ করে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় পর্যালোচনার ভিত্তিতে মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যটি সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুলভাবে জানার চেষ্টা করবো।
তথ্য-১
… … … এরপর আমার কাছ থেকে তোমাদের কাছে পথনির্দেশিকা (কিতাব ও সহীফা) যাবে, তখন যারা আমার সেই পথনির্দেশিকা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণও থাকবে না। (সুরা বাকারা/২ : ৩৮)
ব্যাখ্যা : মানব-জাতির আদি পিতা আদম (আ.) ও আদি মাতা হাওয়া (আ.) জান্নাতে মহা তথ্যসন্ত্রাসী ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার পর গভীর অনুশোচনাসহ আল্লাহর কাছে তাওবা করেন। আল্লাহ তাঁদের তাওবা কবুল করার পর বলেন- তোমাদের কিছু-কালের জন্য দুনিয়ায় যেতে ও থাকতে হবে এবং ইবলিসও তোমাদের সাথে সেখানে থাকবে। একথা শুনে মানব জাতির পিতা ও মাতা ভীষণ ভয় ও দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ঐ ভয় ও দুশ্চিন্তার কারণ ছিল- তাঁরা ভাবছিলেন, ইবলিস ষড়যন্ত্র/তথ্যসন্ত্রাস করে তাঁদেরকে দিয়ে দুটি মারাত্মক বিষয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছে- আাল্লাহর স্পষ্ট আদেশের ভুল ব্যাখ্যা গ্রহণ করানো এবং জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো।
তাই, ইবলিসের পক্ষে ষড়যন্ত্র করে তাদের সকল সন্তানকে বহু মৌলিক ভুল/মিথ্যা কথা গ্রহণ করিয়ে বিভিন্ন ধরনের কবীরা গুনাহ করানো এবং তার ফলস্বরূপ জাহান্নামে পাঠানো মোটেই কঠিন হবে না। মানব জাতির পিতা ও মাতার ঐ দুশ্চিন্তার জবাব হলো আলোচ্য আয়াতটি।
আয়াতটির মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে- যুগে যুগে তাঁর কাছ থেকে মানুষের জীবন পরিচালনার বিভিন্ন দিক বিশেষ করে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক তথ্য ধারণকারী পথনির্দেশিকা (কিতাব/গ্রন্থ/Manual) দুনিয়ায় যাবে। যারা ঐ কিতাব অনুসরণ করবে তথা জ্ঞানার্জন ও তাঁর অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করবে তাদের কোনো ভয় থাকবে না।
তথ্য-২
মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয় বরং সে আল্লাহর রসূল এবং সকল নবীদের শেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে অবগত।
(সুরা আহযাব/৩৩ : ৪০)
ব্যাখ্যা : আয়াতটি থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়, মুহাম্মাদ স. আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত সর্বশেষ রসুল ও নবী।
তথ্য-৩
আর এভাবে আমরা তোমার প্রতি আমাদের নির্দেশ সম্বলিত ওহী (আল কুরআন) প্রেরণ করেছি। (এর পূর্বে) তুমি জানতে না কিতাব কী ও ঈমান কী, কিšদআমরা একে বানিয়েছি একটি আলো (জ্ঞানের আলো) যা দিয়ে (অতাৎক্ষণিকভাবে) আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে পরিচালিত করি। আর নিশ্চয় তুমি অবশ্যই স্থায়ী সঠিক পথ প্রদর্শন করো।
(সুরা শুরা/৪২ : ৫২)
ব্যাখ্যা : আয়াতটি থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়- মুহাম্মাদ স.-এর ওপর আল্লাহর কিতাব কুরআন নাযিল হয়। তাই, কুরআন হলো আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবের শেষ সংস্করণ।
তথ্য-৪
রমযান মাস। যে মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। (কুরআন) সকল মানুষের জন্য জীবন পরিচালনার পথনির্দেশিকা এবং পথনির্দেশিকার মধ্যে এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত শিক্ষাধারণকারী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। … … (সুরা আল বাকারা/২ : ১৮৫)
ব্যাখ্যা : আয়াতটিতে প্রথমে কুরআনকে একটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত শিক্ষাধারণকারী পথনির্দেশিকা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কুরআন হলো এমন একটি গ্রন্থযেটিতে মানুষের জীবন পরিচালনার সকল মৌলিক তথ্য আছে। তাই, আয়াতটির আলোকে সহজে বলা যায়- আল কুরআনে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সে উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, রসুল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য, তাঁকে সঠিকভাবে অনুসরণ করার মাপকাঠি সম্পর্কে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে।
আয়াতটি থেকে আরও জানা যায়- কুরআন হলো সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। অর্থাৎ কুরআনের বিপরীত কথা যে গ্রন্থেই থাকুক তা মিথ্যা। সে গ্রন্থহাদীস, ফিকহ, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি যাই হোক না কেন।
তথ্য-৫
… … … আর তোমার প্রতি যিক্র (আল কুরআন) অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি (কথা ও কাজের মাধ্যমে) মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারো- যা কিছু তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তারাও যেন চিন্তা-গবেষণা করে। (সুরা নাহল/১৬ : ৪৪)
ব্যাখ্যা : আয়াতটি থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায়- মুহাম্মাদ স.-এর দায়িত্ব ছিল কুরআনকে কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া।
তথ্য-৬
তোমরা (মানুষ) সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে, তোমরা (জন্মগতভাবে) জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। (সুরা আলে ইমরান/৩ : ১১০)
ব্যাখ্যা : আয়াতটিতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সারসংক্ষেপ আকারে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই, আয়াতটির বক্তব্য পুস্তিকার আলোচ্য বিষয়ের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। কারণ, মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণ করা হয়েছে, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে দুনিয়ার মানুষদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যেন তাঁর চলে যাওয়ার পর মানুষ ঐভাবে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে যেতে পারে।
আয়াতটির প্রকৃত ব্যাখ্যা বুঝতে হলে যে বিষয় আগে জানতে হবে তা হলো-
১. কুরআনে উম্মাত শব্দটি যে সকল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো জাতিগত সৃষ্টি। যেমন- আর পৃথিবীতে বিচরণকারী এমন কোনো জীব নেই অথবা নিজ ডানার সাহায্যে উড়ে এমন কোনো পাখি নেই, যারা তোমাদের মতো একটি উম্মত (সৃষ্টিগত জাতি) নয়। … … …
(সুরা আন’আম/৬ : ৩৮)
২. মানুষের জীবনের কাজগুলো ৪ শ্রেণিতে বিভক্তÑ
ক. উপাসনামূলক কাজ।
যেমন : ঈমান আনা, সালাত (নামাজ), সিয়াম (রোজা), হাজ্জ, যাকাত, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি। খ. ন্যায়-অন্যায় কাজ
যেমন : সত্য কথা বলা, মিথ্যা না বলা, কাউকে ফাঁকি না দেওয়া, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজে পেট ভরে খেলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী না খেয়ে থাকছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখা, নিজে প্রাসাদসম বাড়িতে থাকলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর থাকার জন্যে বাড়ী-ঘর আছে কি না সে দিকে নজর দেওয়া, নিজের ভালো চিকিৎসা করালে অন্যরা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি।
গ. শরীর-স্বাস্থ্য গঠনমূলক কাজ
যেমন : খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা, বিশ্রাম, ব্যায়াম ইত্যাদি।
ঘ. পরিবেশ-পরিস্থিতি গঠনমূলক কাজ
যেমন : সাধারণ শিক্ষা, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি।
আলোচ্য (আলে ইমরান/৩ : ১১০) আয়াতটির অংশভিত্তিক শিক্ষা
‘তোমরা সর্বোত্তম উম্মত’ অংশের শিক্ষা : মানুষ হলো আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিগত সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত)।
‘তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানুষের কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে’ অংশের শিক্ষা : মানুষকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ করা (মানুষ মানুষের জন্য)।
‘তোমরা জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করবে’ অংশের শিক্ষা : এ কথার অর্থ হলো- তোমাদের মন জন্মগতভাবে যে বিষয়গুলো জানে তা পালন বা বাস্তবায়ন করবে এবং যা অস্বীকার করে তা থেকে দূরে থাকবে বা তা প্রতিরোধ করবে।
তাই, জানা বিষয় বাস্তবায়ন এবং অস্বীকার করা বিষয় প্রতিরোধ করা কথাটির প্রকৃত অর্থ হলো- তোমাদের জন্মগতভাবে জানা ন্যায় বিষয়গুলো বাস্তবায়ন এবং অন্যায় বিষয়গুলো প্রতিরোধ করবে।
‘আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে’ অংশের শিক্ষা : ঈমান হলো- জ্ঞান+ বিশ্বাস। তাই, আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা কথাটির অর্থ হবে- আল্লাহ সম্পর্কে জানা ও তা বিশ্বাস করা। আর মানুষ একটি বিষয় প্রকৃতভাবে বিশ্বাস করে থাকলে সেটি তার কাজে অবশ্যই প্রকাশ পাবে।
আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের পরিপূর্ণ আধার হলো আল-কুরআন। আবার কুরআন হলো সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। অর্থাৎ মানদ-। তাই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখা কথাটির সর্বাধিক তথ্যবহুল অর্থ হবে কুরআনকে সকল জ্ঞানের আধার ও মানদ- হিসেবে বিশ্বাস করা।
প্রশ্ন হলো- জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজ বাস্তবায়ন এবং অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করার সাথে কুরআনকে সকল জ্ঞানের আধার ও মানদ- হিসেবে বিশ্বাস করার কথাটিকে কেন যুক্ত করা হয়েছে-
এ প্রশ্নের উত্তর-
১. ন্যায় ও অন্যায় কাজ কোনগুলো তা আল্লাহ প্রথমে রুহের জগতে সাক্ষ্য ও ক্লাস নিয়ে প্রত্যেক রুহকে জানিয়ে দিয়েছেন এভাবে-
অতঃপর তিনি আদমকে সকল (গুণবাচক) ইসম শেখালেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন, অতঃপর বললেন- তোমরা আমাকে এ ইসমগুলো সম্পর্কে বলো যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো। (সুরা আল বাকারা/২ : ৩১)
ব্যাখ্যা : গুণবাচক ইসম হলো মানব-জীবনের ন্যায়-অন্যায়, সাধারণ নৈতিকতা, বান্দার হক বা মানবাধিকারের বিষয়সমূহ। তাই, আল্লাহ তা‘য়ালা শাহী দরবারে ক্লাস নিয়ে, সকল মানব রুহকে সব ন্যায়-অন্যায় বিষয় শিখিয়েছেন।
অতঃপর ঐ বিষয়গুলো মহান আল্লাহ মানব ভ্রূণের ব্রেইনে Common Sense নামক জ্ঞানের উৎস (Micro Chips) হিসেবে জন্মগতভাবে দিয়ে দিয়েছেন। তথ্যটি কুরআন জানিয়েছে এভাবেÑ
শপথ মনের এবং সেই সত্তার যিনি তাকে (মনকে) সঠিক গঠনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে (মনকে) ‘ইলহাম’ করেছেন তার অন্যায় ও ন্যায় (বোঝার শক্তি)।
(সুরা আশ্ শামস/৯১ : ৭ ও ৮)
ব্যাখ্যা : আয়াত দু‘টি থেকে জানা যায়- ইলহাম নামক এক অতিপ্রাকৃতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষের মনে অন্যায় ও ন্যায় বিষয়গুলো বোঝার একটি জ্ঞানের শক্তি দিয়েছেন। জ্ঞানের ঐ শক্তিটি হলো আকল, বিবেক, কা-জ্ঞান বা Common Sense।
জন্মগতভাবে পাওয়া জ্ঞানের ঐ উৎসটি শিক্ষা ও পরিবেশের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তথ্যটি কুরআন জানিয়েছে নি¤েœর আয়াতসহ আরও আয়াতের মাধ্যমে-
অবশ্যই সে সফল হবে যে তাকে (Common Sense) উৎকর্ষিত করবে। আর অবশ্যই সে ব্যর্থ হবে যে তাকে (Common Sense) অবদমিত করবে।
(সুরা আশ্ শামস/৯১ : ৯ ও ১০)
ব্যাখ্যা : আয়াত দু‘টি থেকে জানা যায়- Common Sense উৎকর্ষিত ও অবদমিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদির মাধ্যমে Common Sense পরিবর্তিত হয়।
আল কুরআনে ঐ ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলোর তালিকা নির্ভুল ও পরিপূর্ণভাবে উল্লিখিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে। তাই, মানুষকে তার জন্মগতভাবে জানা ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলোকে কুরআনের আলোকে যাচাই করে সেগুলোর নির্ভুলতা ও পরিপূর্ণতা সম্পর্কে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করার প্রকৃত অর্থ হলো কুরআনে উল্লিখিত সকল ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করা।
২. ঐ ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলোর মৌলিক বাস্তবায়ন পদ্ধতিও আল কুরআনে নির্ভুলভাবে উল্লিখিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে।
৩. আবার ঐ ন্যায় ও অন্যায় কাজগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যোগ্য মানুষ তৈরির প্রোগ্রামও কুরআনে নির্ভুলভাবে উল্লিখিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে।
ঐ ধরনের যোগ্য মানুষ ছাড়া কেউ ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গেলে তা সমগ্র মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না। তা হবে ব্যক্তি, পরিবার, দল বা নিজ (ভৌগলিক জাতির) স্বার্থ উদ্ধারের জন্য।
তাই, এ আয়াত থেকে প্রত্যক্ষভাবে যা জানা যায়-
১. মানুষ হলো মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতিগত সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত)। ২. মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলোÑ মানুষের কল্যাণ করা (মানুষ মানুষের জন্য)।
৩. সে কল্যাণের উপায় হলো- মানুষের জন্মগতভাবে জানা ন্যায় কাজগুলো বাস্তবায়ন এবং অন্যায় কাজগুলো প্রতিরোধ করা। আর এটি করার সময় কুরআনকে ন্যায়-অন্যায়সহ সকল কাজ ও বিষয়ের নির্ভুল ও পরিপূর্ণ উৎস এবং মানদ- হিসেবে বিশ্বাস ও মান্য করতে হবে।
আলোচ্য আয়াতটি ও কুরআনে উপস্থিত মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্য সকল আয়াত পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে নিশ্চিতভাবে জানা যায়, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে- ওপরের দুই নম্বর ধারা তথা ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো করা।
আর মানুষের জীবনের অন্য সকল বিভাগের কাজ হচ্ছে ঐ উদ্দেশ্য সাধনের পাথেয়। অর্থাৎ ঐ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়। অন্যদিকে পাথেয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উপাসনা বিভাগের কাজগুলো। কারণ, ঐ কাজগুলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে মানসিক ও মৌলিক বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে যোগ্য জনশক্তি তৈরি করে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য’ (গবেষণা সিরিজ-১) নামক বইটিতে।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপায়
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানার পর পুস্তিকাটির আলোচ্য বিষয়ের সাথে যে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হলো- মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপায়। কারণ, মুহাম্মাদ স.-কে পৃথিবীতে প্রেরণই করা হয়েছে- মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে দুনিয়ার মানুষদের দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই, এ বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারলে মুহাম্মাদ স.- কে প্রেরণের উদ্দেশ্যটিও সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যাবে।
Common Sense
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপায় বোঝা সহজ হবে যদি ন্যায়-অন্যায় কাজের আল্লাহর জানানো তালিকাটি আমরা জেনে নিতে পারি। কুরআনে উল্লিখিত ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলোর কয়েকটি হলো (সবগুলো বর্ণনা করা এই ছোট্ট পুস্তিকায় সম্ভব নয়)-
১. সত্য কথা বলা, মিথ্যা না বলা, কাউকে ফাঁকি না দেওয়া, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজে পেট ভরে খেলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী না খেয়ে থাকছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখা, নিজে প্রাসাদসম বাড়িতে থাকলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর থাকার জন্যে বাড়ী-ঘর আছে কি না সে দিকে নজর দেওয়া, নিজের ভালো চিকিৎসা করালে অন্যরা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে ভুমিকা রাখা ইত্যাদি।
২. অবৈধ যৌন মিলন না করা এবং অবৈধ যৌনাচারকারী বিবাহিত নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা এবং অবিবাহিত নারী-পুরুষকে প্রকাশ্যে অপমানকর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। (কারণ, অবৈধ যৌনাচার চলতে থাকলে একদিন পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে)
(সুরা নূর/২৪ : ২)
৩. মানুষকে অবৈধ হত্যা থেকে বাঁচানোর জন্যে অবৈধ হত্যাকারীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্রুত বিচার করে জনসমক্ষে হত্যা করা। (এটাকে কুরআনে কেসাস বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে, এই কেসাস-এর আইন হচ্ছে মানুষের জীবন) (সুরা বাকারা /২ : ১৭৯)
৪. চুরি না করা এবং ধনীরা চুরি করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্রুত বিচার করে তাদের হাত কেটে দেওয়া। (পেটের দায়ে কেউ চুরি করলে তাকে কোনো শাস্তি না দিয়ে বরং চুরির কারণটা দূরীকরণের ব্যবস্থা করা।) (সুরা মায়েদা/৫ : ৩৮)
৫. সুদ না খাওয়া এবং সুদী অর্থ ব্যবস্থা উৎখাত করে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এ জন্যে দরকার হলে যুদ্ধ ঘোষণা করা। (কারণ, সুদ হচ্ছে সমাজের বিত্তবানদের মাধ্যমে বিত্তহীনদের শোষণের ব্যবস্থা) (সুরা বাকারা/২ : ২৭ )
৬. সব ধরনের অশ্লীল কাজকে প্রতিরোধ করা।
(সুরা নাহল/১৬ : ৯০)
৭. ঘুষ, দুর্নীতি, জুয়া, মদ্যপান ইত্যাদি কাজকে প্রতিরোধ করার জন্যে সব ধরনের ব্যবস্থা করা। (সুরা নাহল/১৬ : ৯০)
৮. সমাজ থেকে সব ধরনের জুলুম ও অত্যাচারকে উৎখাত করা এবং এ জন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা। (সুরা নিসা/৪ : ৭৫)
৯. সৃষ্টি জগৎ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা বা তা যাতে করা হয় সে বিষয়ে ভুমিকা রাখা। (সুরা আলে ইমরান/৩ : ১৯১)
ওপরে বর্ণিত ন্যায়-অন্যায় কাজগুলো আমরা যেভাবে বর্ণনা করেছি, কুরআনে হুবহু সেভাবে বর্ণনা করা নেই। কুরআনের মৌলিক নির্দেশের সঙ্গে হাদীসের ব্যাখ্যা এবং রসূল স. ও পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামগণ সেটা যেভাবে বাস্তবে রূপদান করেছেন তা মেলালে যা দাঁড়ায়, সেভাবে নির্দেশগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
Common Sense-এর আলোকে অতি সহজে বলা যায়- কুরআনে থাকা ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজের যে কয়েকটি ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু সেগুলো কোনো সমাজে বাস্তবায়ন করা একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন সেখানকার সরকার তা চাইবে। অনৈসলামিক সমাজ বা দেশে কুরআনে বর্ণিত দু’চারটি নির্দেশ হয়তো আপনি সেভাবে পালন বা বাস্তবায়ন করতে পারবেন যেভাবে করলে ক্ষমতাসীন সরকারের দেশ শাসন করতে কোনো অসুবিধা না হয়।
তাহলে Common Sense-এর আলোকে সহজেই বলা যায়- জন্মগতভাবে জানা এবং কুরআনে উপস্থিত থাকা সকল ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করা পৃথিবীর একটি দেশে শুধুমাত্র তখনই সম্ভব যখন সে দেশের সরকার তা চাইবে। অর্থাৎ কুরআন বা ইসলাম সে দেশে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকলেই শুধু তা সম্ভব। আর সমস্ত পৃথিবীতে তা করতে হলে, গোটা পৃথিবীতে কুরআন বা ইসলামকে বিজয়ী হতে হবে।
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো- কুরআনকে সকল জ্ঞানের নির্ভুল ও পরিপূর্ণ উৎস এবং মানদ- হিসেবে বিশ্বাস ও মান্য করে জন্মগতভাবে জানা সকল ন্যায় কাজ বাস্তবায়ন ও অন্যায় কাজ প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ করা।
তাই, সহজে বলা যায় যে- মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সুতরাং, মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য হবে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
♣♣ তাহলে ২৩ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত নির্ভুল জ্ঞানার্জনের ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী রসূল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যে সম্পর্কে ইসলামের প্রাথমিক রায় হলো- ‘ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা’।
আল কুরআন
তথ্য-১
প্রচলিত অনুবাদ : তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসুলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা), উহাকে (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাকে) অন্য সকল জীবন-ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
(সুরা তাওবা/৯ : ৩৩)
তথ্য-২
প্রচলিত অনুবাদ : তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসুলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা), উহাকে (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাকে) অন্য সকল জীবন-ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
(সুরা ছফ/৬১ : ৯)
তথ্য-৩
প্রচলিত অনুবাদ : তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসুলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা), উহাকে (ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাকে) অন্য সকল জীবন-ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
(সুরা ফাত্হ/৪৮ : ২৮)
আয়াত তিনটির প্রচলিত অনুবাদের সম্মিলিত পর্যালোচনা
দু‘টি দিকের আলোকে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করবো-
১. আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ।
২. বাস্তবতা।
১. আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ
▪ দৃষ্টিকোণ-১ : ইযহিরু শব্দটির দৃষ্টিকোণ
আয়াত তিনটির প্রত্যেকটিতে ইযহিরু শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী অভিধানে এ শব্দটির সরাসরি (প্রত্যক্ষ) অর্থ হলো- প্রতিষ্ঠিত করা, প্রকাশ করা, উন্মুক্ত করা, স্পষ্ট করা, আলোতে আনা, অন্ধকারমুক্ত করা ইত্যাদি। বিজয়ী করা সরাসরি (প্রত্যক্ষ) অর্থ নয়।
▪ দৃষ্টিকোণ-২ : হু সর্বনামটির দৃষ্টিকোণ
আয়াত তিনটির প্রত্যেকটিতে ইযহিরু শব্দটির শেষে হু সর্বনামটি ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দটি একবচন। বহুবচন নয়। এ শব্দটির বহুবচন হলো হুম। তাই, এ সর্বনামটি যে শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে সেটি একবচন হতে হবে। কিšদপ্রচলিত অনুবাদে শব্দটি হলো বহুবচন (অন্য সকল জীবন-ব্যবস্থা)। তাই, এ অনুবাদ গ্রহণযোগ্য হবে না।
২. বাস্তবতা
তথ্য এক ও দুইয়ের আয়াত দু’টির শেষাংশের বক্তব্য হলো- যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। তাই, আয়াত দু’টির প্রথমাংশে যা বলা হয়েছে সে বিষয়টি এমন হতে হবে যা ঘটলে সকল মুশরিকরা তা অপছন্দ করবে।
মুশরিক দু’ধরনের : কাফির মুশরিক ও মু’মিন মুশরিক। এ তথ্যটি কুরআন থেকে জানা যায় এভাবে- আর আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে বহু আয়াত রয়েছে, তারা এ সবের ওপর দিয়ে চলাচল করে কিন্তুতারা এ সবকে উপেক্ষা করে। আর তাদের (মানুষের) অধিকাংশই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, মুশরিক হওয়া ছাড়া। (সুরা ইউসুফ/১২ : ১০৫, ১০৬)
বাস্তবতা হলো- বর্তমানে যদি একটি মুসলিম দেশ (ধরা যাক মিশর) অমুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয় তাহলে মু‘মিন মুশরিকরা খুশি হবে। কিন্তু কাফির মুশরিকরা অখুশি হবে।
এ দৃষ্টিকোণ থেকেও তাই আয়াত ৩টির প্রচলিত অনুবাদ গ্রহণযোগ্য হবে না।
আয়াত তিনটির প্রকৃত অনুবাদ
তথ্য-১
তিনি (আল্লাহ) তাঁর রাসূলেকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ, উহাকে (সত্য জীবন ব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, জীবন-ব্যবস্থা নামক বিষয়টির (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি) সকল অঙ্গনে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
(সুরা তাওবা/৯ : ৩৩)
তথ্য-২
তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ, উহাকে (সত্য জীবন ব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, জীবন-ব্যবস্থা নামক বিষয়টির (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি) সকল অঙ্গনে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।
(সুরা ছফ/৬১ : ৯)
তথ্য-৩
তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ, উহাকে (সত্য জীবন ব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, জীবন-ব্যবস্থা নামক বিষয়টির (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি) সকল অঙ্গনে। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
(সুরা ফাত্হ/৪৮ : ২৮)
আয়াত তিনটির প্রকৃত অনুবাদের সম্মিলিত পর্যালোচনা
আয়াত তিনটিতে রসূল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য কী তা সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আয়াত তিনটি রসুল মুহাম্মাদ স.-কে সামনে রেখে বলা হলেও সকল নবী-রসূল পাঠানোর এটিই উদ্দেশ্য।
আয়াত তিনটির প্রথম অংশের বক্তব্য অভিন্ন। সে বক্তব্য হলো- ‘তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রাসূলেকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথ নির্দেশনা ও সত্য জীবন-ব্যবস্থাসহ, উহাকে (সত্য জীবন-ব্যবস্থাকে) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, জীবন-ব্যবস্থা নামক বিষয়টির (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি) সকল অঙ্গনে’। এ বক্তব্যের মাধ্যমে মুহাম্মাদ স.- কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্যটি সরাসরি বলে দেওয়া হয়েছে। সে উদ্দেশ্য হলো- জীবন-ব্যবস্থায় যত অঙ্গন (দিক) থাকে তার সকল অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা।
আয়াত তিনটির শেষাংশের বক্তব্য প্রথম দু’টি আয়াতে অভিন্ন। সে বক্তব্য হলো- ‘যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে’। একটি সমাজ বা দেশের প্রতিটি অংঙ্গন তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কাফির ও মু‘মিন উভয় বিভাগের মুশরিকরা তা অপছন্দ করবে। তাই, আয়াত তিনটির এ অর্থ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে। কারণ-
১. ইযহিরু শব্দটির অভিধানিক সরাসরি (প্রত্যক্ষ) অর্থ ‘প্রতিষ্ঠা করা’ গ্রহণ করা হবে।
২. হু সর্বনামটির প্রকৃত অর্থটি (একবচনের অর্থ) গ্রহণ করা হবে।
৩. আয়াত তিনটির অর্থ বাস্তবসম্মত হবে।
অন্যদিকে সহজবোধগম্য বাস্তব অবস্থা হলো- জীবন-ব্যবস্থা নামক বিষয়টির দু-চারটি অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার কিছু আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করা সকল সমাজ বা দেশেই সম্ভব। কিন্তু জীবন-ব্যবস্থার সকল অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা শুধু তখনই সম্ভব হবে যখন ইসলাম সে সমাজ বা দেশে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অর্থাৎ ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা শাসন ক্ষমতায় থাকবে।
♣♣ তাহলে দেখা যায় যে- রসূল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কেইসলামের প্রাথমিক রায়কে (Common Sense-এর আলোকে নেওয়া রায়) কুরআন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। তাই, ২৩ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত নির্ভুল জ্ঞানার্জনের ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী, ঐ প্রাথমিক রায়টিই হবে ইসলামের চূড়ান্ত রায়। অর্থাৎ রসুল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো- ‘ইসলামী জীবন-ব্যবস্থাকে সমাজ বা দেশে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তথা শাসন ক্ষমতায় বসানো।
মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুন্নাহ
রসূল মুহাম্মদ স.-এর জীবন চরিতকে সুন্নাহ বলে। তাই, চলুন এখন রসূল মুহাম্মদ স.-এর জীবন চরিত পর্যালোচনা করে জানার চেষ্টা করা যাক তাঁকে দুনিয়ায় প্রেরণের পেছনে উদ্দেশ্য কী ছিল।
নবুওয়াত পাওয়ার পর ১৩টি বছর রসূল স. অক্লান্ত পরিশ্রম করেন মক্কায় ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য। অতঃপর তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে দূরের লোকদের আগে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা ইসলামের বিধান। তারপরও রসূল স. নিজ মাতৃভূমি, সহায় সম্পদ ও আত্মীয়-স্বজন রেখে মদিনায় চলে গিয়েছিলেন। এর কারণ হলো- রসূল স.-কে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সমাজ বা দেশ মক্কার সকল (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ইত্যাদি) অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার আদেশ, নিষেধ, উপদেশ ও শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহর তৈরি প্রোগ্রাম বা প্রাকৃতিক আইন হলো- কোনো এলাকা বা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যদি একটি মতবাদের সক্রিয় বিরোধী হয় তবে সেখানে সে মতবাদ প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। রসূল স.-এর সময় মক্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল ইসলামের সক্রিয় বিরোধী। তাই আল্লাহর তৈরি প্রোগ্রাম বা প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সেখানে ইসলাম সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব ছিল না। আর তাই রসূল স. মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। আর সেখানে গিয়ে প্রথমেই ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করেন তথা একটি ছোট ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।
তাই, রসূল মুহাম্মাদ স.-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো ইসলামকে সমাজ বা দেশে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা তথা শাসন ক্ষমতায় বসানো, তথ্যটি সুন্নাহও সরাসরি সমর্থন করে।
হিজরাত থেকে ইসলামকে বিজয়ী করার ব্যাপারে শিক্ষা
হিজরাত হলো রসূল মুহাম্মদ স.-এর নবুয়াতী জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আল্লাহ্ সারা জীবন রসূল স.-কে মক্কায় ইসলামের কাজ করে যেতে বলতে পারতেন। কিন্তু তা না বলে তিনি কেন সহায়-সম্পত্তি, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে তাঁকে মদিনায় গিয়ে ইসলামের কাজ করতে বললেন? এই কঠিন নির্দেশের মধ্যে দিয়ে, আল্লাহ্ তা‘য়ালা রসূল স.-এর মাধ্যমে মুসলিমদের কিছু গুরুত্বপূর্ণশিক্ষা দিতে চেয়েছেন। সময়ের আবর্তেমুসলিমরা সে শিক্ষা ভুলে গিয়েছে। আর তারা যে সেটা ভুলে গিয়েছে, তা বুঝা যায় তাদের ইসলাম পালনের ধরন দেখে। বর্তমান বিশ্বেতাদের অধঃপতনের এটা একটা প্রধান কারণ। হিজরাতের ঘটনার মাধ্যমে যে শিক্ষাসমূহ আল্লাহ্ দিতে চেয়েছেন তা হলো-
১. ইসলামকে বিজয়ী করতে হবে তাঁর তৈরি করা প্রোগ্রাম/প্রাকৃতিক নিয়মকে অনুসরণ করে। সেই প্রোগ্রামের একটি বিষয় (অনুঘটক/Factor) হলো- একটি এলাকার বা দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি কোনো আদর্শের সক্রিয় বিরোধী হয়, তবে সেখানে সে আদর্শ বিজয়ী হতে পারে না।
রসূল স.-এর সময় মক্কার অধিকাংশ জনগণ ছিল ইসলামের সক্রিয় বিরোধী। কিন্তু মদিনার অধিকাংশ লোক ছিল ইসলামের পক্ষে অথবা নিষ্ক্রিয় বিরোধী। তাই আল্লাহ, রসূল স.-কে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় গিয়ে ইসলামের কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে তাঁর ক্ষমতা বলে মক্কায় রসুল স.-কে বিজয়ী করে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ, তা করলে পরবর্তীকালে মুসলমানরা এই দোহাই দিতে পারত যে- রসূল স. ইসলামকে বিজয়ী করতে পেরেছিলেন অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে। আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। তাই আমাদের নির্ঝঞ্জাটে যতটুকু পারা যায় ততটুকু ইসলাম পালন করলেই চলবে।
২. যদি বুঝা যায়, নিজ এলাকায় ইসলামকে বিজয়ী করা সম্ভব নয় কিন্তু অন্য এলাকায় সে সম্ভাবনা আছে বা অন্য এলাকায় ইসলাম বিজয়ী আছে, তবে যাদের পক্ষে সম্ভব তাদের নিজ এলাকা ছেড়ে সেখানে চলে যেতে হবে এবং সেখানেই ইসলামকে বিজয়ী করার বা বিজয়ী রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আর এর কারণ হলো- যে এলাকায় ইসলাম বিজয়ী নেই ঐ এলাকায় থাকলে, মন না চাইলেও প্রকৃত মুসলিমদের নানা রকম অনৈসলামিক কাজ করতে হয় বা সহ্য করতে হয়।
তাই নিজ এলাকায় ইসলাম বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে যেখানে বিজয়ী আছে বা বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেখানে হিজরাত করে চলে যেতে হবে। অন্যথায় নিজ এলাকায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা-সাধনা করতে হবে।
এ কথাগুলোই আল্লাহ্সুরা নিসার ৯৭ নং আয়াতে অত্যন্তসুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। কথাগুলো অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ, তাই সহজে বোঝানোর জন্যে আল্লাহ্ তা ফেরেশতা ও মানুষের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। আয়াতটি হচ্ছে-
নিশ্চয় নিজেদের মনের ওপর জুলুমকারীদের (মনের বিরুদ্ধে গুনাহের কাজ করা মু’মিনদের) প্রাণ হরণকালে ফেরেশতাগণ বলে- তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে- পৃথিবীতে আমরা অসহায় ছিলাম। তারা (ফেরেশতারা) বলে- আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরাত করতে পারতে? তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ আবাস! তবে যেসব (প্রকৃত) অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু (হিজরাতের জন্য) কোনো উপায় খুঁজে পায় না এবং কোনো পথও পায় না (তাদের কথা ভিন্ন)।
(সুরা নিসা/৪ : ৯৭-৯৮)
ব্যাখ্যা : অনৈসলামিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করার কারণে, মনকে কষ্ট দিয়ে (আত্মার ওপর জুলুম করে) নানা অনৈসলামিক কাজ করেছে বা সহ্য করেছে এমন মুসলিমদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করবে- ‘মনের কী অবস্থা নিয়ে তোমরা তোমাদের জন্মভূমিতে ছিলে?’ মনের প্রতি জুলুমকারী মুসলিমরা বলবে, ‘আমরা দুর্বল ছিলাম, তাই মনের প্রতি জুলুম করে আমরা আমাদের বাসস্থানে ছিলাম।’ তখন ফেরেশতারা বলবে, ‘আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরত করতে পারতে?’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়ায় কি এমন জায়গা ছিল না, যেখানে ইসলাম বিজয়ী ছিল বা যেখানে গিয়ে তোমরা ইসলামকে বিজয়ী করতে পারতে এবং মনের প্রশান্তি নিয়ে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম পালন করতে পারতে? এরপর জানানো হয়েছে এই অপরাধের জন্যে তাদের পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত খারাপ জায়গা। কুরআন আরও বলছে, ঐ শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে কেবল তারাই, যাদের ভিটে-মাটি ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার মতো শারীরিক শক্তি, সামর্থ, সহায় সম্পদ ইত্যাদি ছিল না।
কী পরিষ্কার কুরআনের কথা! আর রসূল স. কুরআনের এই আয়াতের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। কিšদঅত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজ অধিকাংশ মুসলিম অনৈসলামিক সমাজ বা নামধারী মুসলিম সমাজে বসবাস করে ঐ সমাজ যতটুকু অনুমতি দিচ্ছে শুধু ততটুকু ইসলাম পালন করে খুশী থাকছে। আর ভাবছে এভাবে ইসলাম পালন করে তারা পরকালে শান্তিতে থাকবে। কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের কী উপেক্ষা! তাই না?
লেখক : কুরআন গবেষক, ল্যাপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন এবং চেয়ারম্যান, কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন