স্টাফ রিপোর্টার: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে, বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে বাঙালি জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে, আসুন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।’
রাষ্ট্রপতি আজ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এ আহবান জানান। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় সংসদ দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান সরকার রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের অবসানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও আলোকিত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ সকলকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, সরকার দক্ষ, সেবামুখী, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৫’ মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন, জনপ্রশাসন পদক প্রবর্তন, কর্মকৃতিভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ, সকল ক্যাডার-কর্মকর্তাদের ডাটাবেইজ প্রস্তুত, পদোন্নতি নীতিমালা যুগোপযোগীকরণ, পদায়ন ও বদলি নীতিমালা প্রণয়ন এবং জনগণকে দ্রুত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ই-গভর্ন্যান্স কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে।
তিনি বলেন, ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে ২০১৫ পর্যন্ত ভোটার হিসাবে নিবন্ধিত ৯ কোটি ৭২ লক্ষ ৩৯ হাজার ৪২৫ জন নাগরিকের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও অধিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতার পরিমাণ ৮ হাজার টাকা এবং ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ থেকে ২ লাখে উন্নীত করেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ-বছর থেকে ১০ হাজার টাকা হারে মাসিক সম্মানী ভাতা প্রদান করা হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ও জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাসমূহ নিস্পত্তির ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৫২ হাজার ৯১৩ জন পুলিশ-সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশে আরও ৫০ হাজার পদ সৃজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিসহ প্রায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ ৮০ হাজার ৬৫৯ জন বাংলাদেশি নাগরিককে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং প্রায় ২ লক্ষ ৭৯ হাজার ৮৫০ জন বিদেশি নাগরিককে মেশিন রিডেবল ভিসা প্রদান করা হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে রাজনীতিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশকে মর্যাদাপূর্ণ ‘ওমেন ইন পার্লামেন্ট গ্লোবাল ফোরাম এ্যাওয়ার্ড-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্য-আয়ের জ্ঞানভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধিশালী ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ নিম্ন-আয়ের বৃত্ত ভেঙ্গে ইতোমধ্যে নিম্নমধ্যম-আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এখন জাতির দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে ২০৪১ সালের দিকে – বিশ্ব দরবারে একটি উন্নত দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার মানসে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়ভিত্তিক এবং জ্ঞান-নির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রেখে সরকার নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন, মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ১৮৪ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক তিন শতাংশ, এর মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪-১৫ অর্থ-বছরের রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৮ কোটি টাকা এবং আদায় হয়েছে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৮৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৫ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কৃষি ঋণের সুদের হার ১৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থলসীমানা চুক্তিটি বাস্তবায়নের মুখ দেখে।
তিনি বলেন, ১১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৫৩টি নৌ-রুটে মোট ৩ হাজার ২৭৬ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক-যোগাযোগ সহজীকরণ, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে প্রায় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক চার কিলোমিটার টানেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অচিরেই এ টানেলের নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
আবদুল হামিদ বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাংবাদিক ও সাংবাদিক পরিবারের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে। ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে তথ্য ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিটিভি সদর দপ্তর ভবন ও ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম টিভি কেন্দ্রের আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য জনমিতিক সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ ও ৬ ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রা ৫ অর্জনের পথে রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পোলিওমুক্ত সনদ লাভ করেছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ক্রীড়াক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমান্বয়ে সুদৃঢ় হচ্ছে। ক্রিকেটে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্তিশালী দলগুলিকে বাংলাদেশ পরাজিত করেছে। সম্প্রতি জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলকেও ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ তিন-শূন্য ব্যবধানে পরাজিত করে।
তিনি বলেন, ২০১৪-১৫ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ ১৮ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। ২ কোটি ৫ লক্ষ ৮২ হাজার ৮২৪টি কৃষক পরিবারকে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। সরকার ১০ লক্ষ মেট্রিক টনের অধিক পরিমাণ আগাম খাদ্য-সংরক্ষণ নিশ্চিত করেছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ-কিলোমিটার এলাকায় মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৫৩৭টি শিল্প প্রকল্প বেসরকারিখাতে নিবন্ধন প্রদান করা হয়েছে। ‘বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৫’ মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।