প্রফেসর ডা. মো. মতিয়ার রহমান, FRCS ( Glasgow)
কোনো বিষয়ে ইসলামের প্রাথমিক রায়কে (Common sense-এর রায়) যদি কুরআন সমর্থন করে তবে ঐ প্রাথমিক রায় হবে বিষয়টির ব্যাপারে ইসলামের চূড়ান্তরায়। আগেই আমরা মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় সম্পর্কে ইসলামের প্রাথমিক রায় জেনেছি। উল্লিখিত কুরআনের তথ্যগুলো থেকে সহজে বোঝা যায় কুরআন ঐ প্রাথমিক রায়কে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। তাই, নির্ভুল জ্ঞানার্জনের ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বলা যায়, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় সম্পর্কে ইসলামের চূড়ান্ত রায় হলো-
১. জন্মগতভাবে জানা বিষয়গুলো (মানব জীবনের ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো) বাস্তবায়ন করা তথা ন্যায় কাজের বাস্তবায়ন করা এবং অন্যায় কাজগুলো প্রতিরোধ করা হবে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
২. জীবনের অন্য ৩ বিভাগের বিষয় হলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয়। অর্থাৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়। ৩. উদ্দেশ্য ও পাথেয় বিভাগের মৌলিক বিষয়ের সবগুলো পালন করতে হবে।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় সম্পর্কেইসলামের চূড়ান্ত রায় সমর্থনকারী হাদীস
আমাদের গবেষণা অনুযায়ী, হাদীস পর্যালোচনা করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছার মূলনীতি ৪টিÑ ১. সঠিক হাদীস (সনদ ও মতন সহীহ হাদীস) কুরআনের সম্পূরক বা অতিরিক্ত হবে; বিপরীত হবে না। ২. একই বিষয়ের সকল হাদীস পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। ৩. সঠিক হাদীস, সঠিক Common sense -এর (আকলে সালিম) রায়ের বিরোধী হবে না। ৪. সঠিক হাদীস বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের বিরোধী হবে না।
বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে- ‘কুরআন, সুন্নাহ ও Common sense ব্যবহার করে নির্ভুল জ্ঞানার্জনের নীতিমালা (চলমানচিত্র)’ (গবেষণা সিরিজ-১২) এবং ‘প্রচলিত হাদীসশাস্ত্রেসহীহ হাদীস বলতে নির্ভুল হাদীস বুঝায় কি?’ (গবেষণা সিরিজ-১৯) নামক বই দুটিতে।
এ মূলনীতিসমূহ মনে রেখে এখন মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পাথেয় সম্পর্কে হাদীস পর্যালোচনা করা যাক-
হাদীস-১
ইমাম মুসলিম (রহ.) তারিক ইবন শিহাব (রহ.)-এর বর্ণনা সনদের ৮ম ব্যক্তি আবূ বকর ইবন আবী শায়বা (রহ.) থেকে শুনে তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন- তারিক ইবনু শিহাব (আবূ বাক্র ইবনু আবী শাইবার হাদীস) থেকে বর্ণিত, মারওয়ান ঈদের দিন সলাতের পূর্বে খুত্বা দেওয়ার (বিদ‘আতী) প্রথা প্রচলন করে। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘খুতবার আগে সলাত (সম্পন্ন করুন)”।
মারওয়ান বললেন, এখন থেকে সে নিয়ম পরিত্যাগ করা হলো। সাথে সাথে আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী (রা.) উঠে বললেন, ঐ ব্যক্তি তার কর্তব্য পালন করেছে। আমি রসূলুল্লাহ্(স.)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ হতে দেখলে সে যেন হাত দিয়ে (শক্তি প্রয়োগে) পরিবর্তন করে দেয়, যদি তার সে ক্ষমতা না থাকে, তবে মুখ দিয়ে (প্রতিবাদ করে) তা পরিবর্তন করবে। আর যদি সে সাধ্যও না থাকে, তখন মন দিয়ে তা করবে (মনে অনুশোচনা রাখবে ও পরিকল্পনা করবে)। তবে এটা ঈমানের দুর্বলতম পরিচায়ক।
♦ মুসলিম, আস সহীহ, হাদীস নং-১৮৬।
♦ হাদীসটির সনদ ও মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : হাদীসটির শেষ অংশের আবু সা‘ঈদ আল খুদরী (রা.)-এর বক্তব্য থেকে জানা যায়- সামনে অন্যায় হতে দেখলে প্রত্যেক ঈমানদারকে তা শক্তি দিয়ে বন্ধ করতে হবে। কোনো কারণে সেটি না পারলে মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করতে হবে। আর কোনো কারণে তাও সম্ভব না হলে মনে অনুশোচনা থাকতে হবে এবং মনে মনে ঐ অন্যায় কাজ বন্ধ করার পরিকল্পনা করতে হবে। যে ব্যক্তি এই শেষটিও করবে না তার ঈমান নেই বা সে ঈমান আনেনি বলে গণ্য হবে।
ঈমান আনা একটি উপাসনামূলক কাজ। তাই হাদীসটি থেকে জানা যায়, ন্যায়-অন্যায় বিভাগের যে কোনো অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করার বিষয়ে বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী যথাযথ ভূমিকা না রাখলে ‘ঈমান আনা’ নামক উপাসনা বিভাগের আমলটি পালন করা হয়নি বলে ধরা হয়। এর কারণ হলো- ঈমান আনা আমলটির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মন-মানসিকতাকে এমনভাবে গঠন করা যেন তা ন্যায় ও অন্যায় বিভাগের কাজগুলো করার ব্যাপারে ব্যক্তিকে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং যদি দেখা যায়- ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তি ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধের ব্যাপারে কোনো প্রকার ভূমিকা রাখছে না, তবে নিঃসন্দেহে বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তি ঈমান আনা আমলটির অনুষ্ঠানটি করলেও মন-মানসিকতাকে যথাযথভাবে গঠন করেনি। অর্থাৎ ঈমান আনা আমলটির মূল দিকটিতে তার ঘাটতি আছে। আর তাই সে ঈমান আনেনি বলে ধরা হবে।
Common sense অনুযায়ী যে বিষয় দিয়ে কোনো কিছু গঠন করতে চাওয়া হয় তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই, হাদীসটি থেকে জানা যায়- ঈমান আনা বিষয়টি মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়। আর ন্যায়-অন্যায় বিভাগের বিষয়গুলো হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের বিষয়।
হাদীস-২
মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে আনাস ইবন মালিক (রা.)-এর বর্ণনা সনদের ৫ম ব্যক্তি আব্দুল্লাহ (রহ.) থেকে শুনে বর্ণনা করা হয়েছে- আনাস (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) এই কথা ছাড়া কখনও খুতবা দিতেন না যেÑ খিয়ানাতকারীর ঈমান নেই এবং ওয়াদা ভঙ্গকারীর দ্বীন নেই।
♦ আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং-১৩২২২।
♦ হাদীসটির সনদ হাসান।
ব্যাখ্যা : হাদীসটির একটি বক্তব্য হলো-খিয়ানাতকারীর ঈমান নেই। খিয়ানাত করা একটি অন্যায় কাজ। আর ঈমান আনা একটি উপাসনামূলক কাজ। তাই এ হাদীসটি অনুযায়ীও অন্যায় কাজ থেকে দূরে না থাকলে ঈমান আনা নামের উপাসনামূলক আমলটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
আর তাই, ১ নং হাদীসটির মতো এ হাদীসটি ব্যাখ্যা করেও বলা যায়- ঈমান আনা বিষয়টি মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়। আর ন্যায়-অন্যায় বিভাগের বিষয়গুলো হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের বিষয়।
হাদীস-৩
ইমাম মুসলিম (রহ.) আবূ হুরাইরা (রা.)-এর বর্ণনা সনদের ৫ম ব্যক্তি আবূ বকর ইবন ইসহাক (রহ.) থেকে শুনে তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন- আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত। রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মুনাফিকের চিহ্ন ৩টি- সে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে এবং আমানাত রাখলে খিয়ানাত করে।
♦ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং-২২১।
♦ হাদীসটির সনদ ও মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : মুনাফিক হলো সেই ব্যক্তি যে ঈমানের দাবি করে এবং প্রকাশ্যে মানুষকে দেখানোর জন্য কিছু আমল করে কিšদ অন্তরে ঈমান আনে না। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে সে মু’মিন নয়। হাদীসটিতে ৩টি কাজ করা ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা হয়েছে- মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা এবং আমানাতের খিয়ানাত করা। এ ৩টি হলো ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজ। আর ঈমান আনা একটি উপাসনামূলক কাজ। তাই এ হাদীসটি অনুযায়ীও অন্যায় কাজ পালন থেকে দূরে না থাকলে ঈমান আনা নামের উপাসনামূলক আমলটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
আর তাই, ১ নং হাদীসটির মতো এ হাদীসটি ব্যাখ্যা করেও বলা যায়- ঈমান আনা বিষয়টি মানুষ সৃষ্টির পাথেয় বিভাগের বিষয়। আর ন্যায়-অন্যায় বিভাগের বিষয়গুলো হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের বিষয়।
হাদীস-৪
ইমাম মুসলিম (রহ.) পূর্বের হাদীসে উল্লিখিত আবূ হুরাইরা (রা.)-এর বর্ণনা সনদের উকবা ইবন মুকরাম (রহ.) থেকে শুনে তিনি তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন- আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন- মুনাফিকের চিহ্ন ৩টি (এরপর ৩ নং হাদীসটির বক্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য অতঃপর) যদিও সে সওম পালন করে এবং সলাত আদায় করে এবং মনে করে যে, সে মুসলিম।
♦ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং-২২১।
♦ হাদীসটির সনদ ও মতন সহীহ।
হাদীস-৫
আবূহুরাইরা (রা.)-এর বর্ণনা সনদের ৬ষ্ঠ ব্যক্তি আবদুল্লাহ (রহ.) থেকে শুনে ‘মুসনাদে আহমদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে- আবুহুরায়রা (রা.) বলেন- জনৈক ব্যক্তি বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ্ (স.)! অমুক মহিলা সালাত ও যাকাতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তবে সে নিজ মুখ দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী।
লোকটি আবার বললো- ইয়া রসূলাল্লাহ্(স.)! অমুক মহিলা সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে কম সিয়াম রাখে, সাদকা কম করে এবং সালাতও কম পড়ে। তার দানের পরিমাণ হলো পনিরের টুকরা বিশেষ। কিন্তু সে নিজ মুখ দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। তিনি (রসূল স.) বললেন- সে জান্নাতী।
♦ আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং-৯৯২৬।
♦ হাদীসটির সনদ হাসান ও মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : প্রতিবেশীকে মুখ দিয়ে কষ্ট দেওয়া ন্যায়-অন্যায় বিভাগের একটি অন্যায় কাজ। আর সালাত, সিয়াম ও যাকাত হলো উপাসনামূলক কাজ। হাদীসটি অনুযায়ী- প্রচুর সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করার পরও প্রতিবেশীকে মুখ দিয়ে কষ্ট দেওয়ার কারণে প্রথম মহিলাকে জাহান্নামে যেতে হবে। অর্থাৎ তার ঐ উপাসনামূলক আমলগুলো আল্লাহর কাছে কবুল হবে না।
অন্যদিকে কম (ফরজ, ওয়াজিব বাদ না দিয়ে) সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করার পরও প্রতিবেশীকে মুখ দিয়ে কষ্ট না দেওয়ায় দ্বিতীয় মহিলা জান্নাতে যাবে। অর্থাৎ তার ঐ উপাসনামূলক আমলগুলো আল্লাহর কাছে কবুল হবে। এর কারণ হলো- সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি উপাসনামূলক কাজ থেকে আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা দিয়ে গঠন করতে চেয়েছেন। ঐ শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো যথাযথভাবে পালন করার উপযোগী করে মানুষকে গড়ে তোলা।
প্রথম মহিলা প্রচুর সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় করলেও সে ইবাদাতগুলো থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষা নেয়নি। তাই সে মুখ দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়েছে। ফলে তার ঐ আমলগুলো কবুল হয়নি এবং তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। আর দ্বিতীয় মহিলা ঐ আমলগুলো কম করলেও সেগুলো থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষা নিয়েছে। তাই সে মুখ দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়নি। ফলে তার ঐ আমলগুলো কবুল হয়েছে এবং সে জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য হয়েছে।
যে বিষয় দিয়ে কোনো কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় বা গঠন করতে চাওয়া হয় তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই এ হাদীসটি থেকে জানা যায়, সালাত, সিয়াম ও যাকাত তথা উপাসনামূলক আমল হলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয়মূলক বিষয়। আর ন্যায় ও অন্যায় বিভাগের কাজগুলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের বিষয়।
হাদীস-৬
ইমাম বুখারী (রহ.) আবূ হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনা সনদের ৪র্থ ব্যক্তি আদাম ইবন আবূ ইয়াস (রহ.) থেকে শুনে তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন- আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বা মিথ্যা আচরণ ছাড়েনি, তার খাওয়া বা পান করা ছেড়ে দেওয়াতে (সিয়াম পালন) আল্লাহর কোনো দরকার নেই (আল্লাহর কাছে কবুল হবে না)।
♦ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং- ১৯০৩।
♦ হাদীসটির সনদ ও মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : সিয়াম উপাসনা বিভাগের কাজ। আর মিথ্যা কথা বা মিথ্যা আচরণ ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজ। হাদীসটি অনুযায়ী তাই ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলো না করলে উপাসনা বিভাগের আমল কবুল হয় না। এর কারণ হলো উপাসনামূলক আমলের উদ্দেশ্য হলো আমলগুলোর অনুষ্ঠান ও পঠিত বিষয় (যদি থাকে) হতে শিক্ষা দিয়ে মানুষ গঠন করা যেন তারা ন্যায়-অন্যায় বিভাগের কাজগুলোকে যথাযথভাবে পালন করতে পারে।
সিয়ামের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘য়ালা এমন মানুষ গঠন করতে চেয়েছেন যারা পেটে ক্ষুধা ও জৈবিক চাহিদা থাকলেও ন্যায়-অন্যায় বিভাগের অন্যায় কাজগুলো থেকে দূরে থাকবে এবং ন্যায় কাজগুলো যথাযথভাবে পালন করবে।
যে বিষয় দিয়ে কোনো কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় বা গঠন করতে চাওয়া হয় তা সবসময় পাথেয় বিভাগের বিষয় হয়। তাই এ হাদীসটি থেকেও জানা যায়, সালাত, সিয়াম ও যাকাত তথা উপাসনামূলক আমল হলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয়মূলক বিষয়। আর ন্যায় ও অন্যায় বিভাগের কাজগুলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিভাগের বিষয়।
হাদীস-৭
ইমাম মুসলিম (রহ.) আবূ হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনা সনদের ৬ষ্ঠ ব্যক্তি কুতাইবা বিন সাঈদ (রহ.) থেকে শুনে তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে লিখেছেন- আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা কি জানো সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ উত্তর দিলেন, আমাদের মধ্যে দরিদ্র হলো সে যার টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ নেই। রসূলুল্লাহ (স.) বললেন-আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র হলো সে যে কিয়ামতের ময়দানে অনেক সালাত, সিয়াম ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে থাকবে যে, সে কোনো মানুষকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করেছে, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছে, কারো রক্ত অন্যায়ভাবে প্রবাহিত করেছে বা কাউকে অন্যায়ভাবে মেরেছে। অতঃপর তার (সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি) আমল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে তার সকল আমল বিনিময় হিসেবে শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাবিদারদের পাপ তার ওপর চাপানো হবে। অবশেষে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
♦ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৭৪৪।
♦ হাদীসটির সনদ ও মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : মানুষকে গালি দেওয়া, কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা, কারো রক্ত অন্যায়ভাবে প্রবাহিত করা, কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা অন্যায় কাজ। হাদীসটিতে দেখা যায়- কেউ যদি দুনিয়ায় উল্লিখিত অন্যায় কাজগুলো করে তবে শেষ বিচারের দিন তার সালাত, যাকাত, সিয়াম ইত্যাদি উপাসনামূলক আমল বিফলে যাবে এবং তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। তাই ৫ ও ৬ নং হাদীস দুটির মতো এ হাদীসটি থেকেও বোঝা যায়-
ন্যায় কাজ পালন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকা তথা ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। আর উপাসনমূলক কাজগুলো হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির পাথেয়।
হাদীস-৮
জাবের (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন- মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ জিব্রাইল (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন যে, অমুক অমুক শহরকে তার অধিবাসীসহ উল্টিয়ে দাও। তিনি বললেন, হে রব! তাদের মধ্যে তো তোমার অমুক এক বান্দা আছে যে মুহূর্তের জন্যেও নাফরমানি করেনি (উপাসনামূলক আমল হতে দূরে থাকেনি)। রাসূল (সা.) বলেন, তখন আল্লাহ্ তা‘য়ালা বললেন- তাকেসহ সকলের ওপরই শহরটিকে উল্টিয়ে দাও। কারণ, সম্মুখে পাপাচার (অন্যায় কাজ) হতে দেখে মুহূর্তের জন্য তার চেহারা মলিন হয়নি।
♦ বাইহাকী, শুআবুল ঈমান (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪১০ হি.) হাদীস নং-৭৫৯৫। ♦ হাদীসটির মতন সহীহ।
ব্যাখ্যা : হাদীসটি থেকে জানা যায়- একটি শহরকে উল্টিয়ে দেওয়ার আদেশ পাওয়ার পর জিব্রাইল (আ.) শহরটিতে থাকা একটি লোকের শাস্তি ভোগ করার কারণ জানার জন্য আল্লাহকে বলেছিলেন- ‘সে ব্যক্তি তো মুহূর্তের জন্যও তাঁর নাফরমানি করেনি তথা সে তো সকল উপাসনামূলক আমল পালন করছে’। জিব্রাইল (আ.)-এর ঐ কথার উত্তরে আল্লাহ বলেছেনÑ ‘সম্মুখে পাপাচার তথা অন্যায় কাজ হতে দেখে মুহূর্তের জন্যও তার চেহারা মলিন হয়নি’।
সম্মুখে পাপাচার হতে দেখে মুহূর্তের জন্যও চেহারা মলিন না হওয়ার অর্থ হলো- অন্যায় কাজ হতে দেখে তা প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া এমনকি মনে অনুশোচনাও না হওয়া। তাই, পূর্বের হাদীসগুলোর মতো এ হাদীসটি থেকেও জানা যায়- ন্যায় কাজ পালন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকা তথা ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ হলো মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। আর উপাসনমূলক কাজগুলো হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির পাথেয়।
সম্মিলিত শিক্ষা : উল্লিখিত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায় যে- ন্যায় কাজ পালন করা এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকা তথা ন্যায়ের বাস্তবায়ন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ হচ্ছে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। আর জীবনের অন্য ৩ বিভাগের কাজ (উপাসনা, শরীর-স্বাস্থ্য গঠন ও পরিবেশ-পরিস্থিতি গঠন) হলো মানুষ সৃষ্টির পাথেয়। এ ধরনের আরও হাদীস হাদীসশাস্ত্রে আছে।
লেখক : কুরআন গবেষক, ল্যাপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন এবং চেয়ারম্যান, কুরআন রিসার্চ ফাউন্ডেশন