আশি বছরের বৃদ্ধের দেহের মধ্যে যদি থাকে চার বছরের শিশু, ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে? হলিউডের সেই বিখ্যাত ছবি ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেনজামিন বাটন’ অথবা বলিউড এর ‘পা’ যারা দেখেছেন, এরকম কাহিনীর সঙ্গে তারা পরিচিত।
মাগুরার বায়জিদ শিকদার যেন বাস্তবের সেই বেনজামিন বাটন। জন্ম ২০১২ সালের ১৪ই মে। সেই হিসেবে বয়স এখন চার বছরের কিছু বেশি।
কিন্তু বায়জিদ শিকদারের দিকে তাকালে চমকে উঠবেন যে কেউ। তার চার বছরের ছোট্ট দেহটার ওপর কেউ যে বসিয়ে দিয়েছে আশি বছরের বৃদ্ধের মুখ। চাহনি, অঙ্গভঙ্গিও অনেকটা বৃদ্ধ মানুষের মতো। শরীর এর মধ্যেই কুঁজো হয়ে গেছে। ঝুলে পড়েছে শরীরের চামড়া।
ডাক্তারদের ধারণা, অত্যন্ত বিরল এবং জটিল কোন জেনেটিক রোগে আক্রান্ত বায়জিদ। এ ধরণের বিরল ‘জেনেটিক ডিজঅর্ডারে’ আক্রান্ত আরও একশোর বেশি শিশু আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ‘প্রোজেরিয়া’ বা ‘হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম’।
মূলত এই রোগে আক্রান্তরা দ্রুত বুড়িয়ে যেতে থাকে, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ছয়গুন দ্রুত হারে।
বায়জিদ শিকদার ঠিক প্রোগেরিয়াতেই আক্রান্ত কিনা, সেটা কোন চিকিৎসক এখনো বলেন নি তার বাবা মাকে। তবে বায়জিদের সমস্ত লক্ষণই মিলে যায় প্রোজেরিয়ার যে লক্ষণ তার সঙ্গে।
বাস্তবের বেনজামিন বাটন:
বায়জিদের বাবা লাভলু শিকদার আর মা তৃপ্তি খাতুন থাকেন মাগুরার খালিয়া গ্রামে। বায়জিদ তাদের প্রথম সন্তান। ২০১২ সালের ১৪ই মে মাগুরার এক সরকারি হাসপাতালে বায়জিদের জন্ম দেন তৃপ্তি খাতুন।
প্রথম যখন সদ্যজাত শিশুর মুখ দেখলেন, চমকে উঠেছিলেন তারা। একটা কংকালসার ছোট্ট দেহের ওপর ঝুলে আছে চামড়া। ভড়কে গেলেন চিকিৎসকরাও।
এরপর এই হাসপাতাল সেই হাসপাতাল ছোটাছুটি। কিন্তু কেন একটি নবজাতক শিশুর চেহারা এমন বুড়ো মানুষের মতো, কেন তার শরীরের চামড়া এখনই এমন ঝুলে পড়েছে, বলতে পারলেন না কেউই।
লাভলু শিকদার রঙ মিস্ত্রীর কাজ করেন। টানা-টানির সংসার। সন্তানকে দেখাতে গিয়েছিলেন ফরিদপুরের হাসপাতালে। এর বেশি সাধ্য নেই তার।
তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল টেলিফোনে। বললেন, তার সাধ্যের মধ্যে যেখানে যেখানে যাওয়া সম্ভব সেখানে গিয়েছেন।
“আমার ছেলে জন্মের পর মাগুরা সদর হাসপাতালে ছিল। ডাক্তাররা বলতে পারছিল না, কি ব্যাপারটা। তারপর আমরা ফরিদপুর গেলাম। ফরিদপুরের ওরাও কিছু বলতে পারে না।” বায়জিদ শিকদারের অস্বাভাবিকতার কথা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। বাড়িতে দেখতে আসে অনেকে।
‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেনজামিন বাটন’ ছবিতে বেনজামিনের জন্ম হয় বৃদ্ধ হিসেবে। এরপর তার বয়স কমতে থাকে।
তবে বায়জিদ শিকদারের ক্ষেত্রে তা নয়, তার বয়স বাড়ছে। দ্রুত বাড়ছে। চার বছরেই তাকে দেখায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক অশীতিপর বৃদ্ধের মতো।
লাভলু শিকদার জানান, জন্মের পর প্রথম চার-পাঁচ মাস মায়ের বুকের দুধ খেয়েছে বায়জিদ। এর পর আর সব শিশুর মতো ভাত এবং অন্যান্য খাবার খেতে শুরু করে।
বায়জিদ হাঁটা, চলাফেরা, কথাবার্তা সবই আর সব শিশুর মতো। একটা অস্বাভাবিকতার কথা জানালেন বাবা লাভলু শিকদার, সেটা হলো বেশি কথা বলে তার ছেলে। “এত কথা বলে, অনেক বড় মানুষও এত কথা বলতে পারবে না। চার বছরের শিশুর তুলনায় সে অনেক বেশি কথা বলে।”
বায়জিদ এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বাড়িতেই সে পড়ালেখা শুরু করেছে।
“বই কিনে দিয়েছি। বাড়িতেই সে পড়াশুনা করে তার স্মরণশক্তি খুব ভালো। যে কোন কিছু একবার শুনলে বা পড়লেই সে মনে রাখতে পারে।”
লাভলু শিকদার জানান, বায়জিদকে সবাই ভালোবাসে। পাড়াপ্রতিবেশী সবাই। যে কোন শিশুর মতই সে অন্যশিশুদের সঙ্গে খেলাধূলা করে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলে।
বিরল রোগ প্রোজেরিয়াঃ
বায়জিদের সব শারীরিক লক্ষণ মিলে যায় বিরল রোগ প্রোজেরিয়ার সঙ্গে, যদিও এখনো বাংলাদেশের কোন ডাক্তার সেটা লাভলু শিকদার বা তার স্ত্রীকে বলেন নি।
প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৪৬টি দেখে এই রোগে আক্রান্ত ১৩৪ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এটি বিশ্বের বিরলতম রোগগুলোর একটি।
খুব সহজ করে বলতে গেলে, প্রোজেরিয়ায় আক্রান্তদের বয়স বাড়ে খুবই দ্রুত, স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ বেশি হারে। ফলে এরা সাধারণত ১৪ বছরের মধ্যেই মারা যায়। তবে এই জেনেটিক কন্ডিশনে আক্রান্ত শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কিন্তু আর দশটা শিশুর মতই।
লাভলু শিকদার চান, তার ছেলেকে আর দশটা শিশুর মতো সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু তার আর্থিক সামর্থ্য নেই। কারও সাহায্য পেলে ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন, সেটাই তার আশা।