নিজস্ব সংবাদদাতা- দেশের ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের অন্যতম অনুষঙ্গ। সম্পূর্ণ বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ আদালতে দণ্ড প্রদান করেন। এজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের তদারকির সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আইন কমিশন।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক ৪ আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদনটি জমা দেন। এ বিষয়ে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যখন আদালত পরিচালনা করেন, তখন সেই আদালত বর্তমান আইনি কাঠামোর আওতায় একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত হিসেবেই কাজ করেন। ফলে দেশের অন্য আদালতের মতো ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর কিছুটা হলেও সুপ্রিম কোর্টের তদারকি ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের তদারকির যৌক্তিকতা দেখিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দণ্ড প্রদান করেন, তখন তিনি পূর্ণ বিচারিক ক্ষমতা ও এখতিয়ার ব্যবহার করেই এ দণ্ড দেন। ফলে এ পূর্ণ বিচারিক কার্যক্রমের আপিল যেমন নিয়মিত আদালতে হওয়া উচিত, তেমনি দেশের অন্য আদালতের মতো সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতেই এ আদালতগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অন্তত ভ্রাম্যমাণ আদালত-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান যাতে সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত প্রেরণ করেন, সে সুপারিশও করা হয়।
জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটিতে দেয়া প্রতিবেদন আইন কমিশনের বক্তব্য। এটা আমারও বক্তব্য। পূর্ণ বিচারিক এখতিয়ার নিয়ে যখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট বিচার করে থাকেন, সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের কিছুটা তদারকি থাকা প্রয়োজন।’ সুপ্রিম কোর্টের তদারকির পাশাপাশি আইনটির আপিল বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দেয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপিল করার অর্থ কেবল একটি আপিল স্তর বৃদ্ধি। এর আর তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দণ্ডাদেশ দিলে প্রথমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপিল করার বিধান রয়েছে। আপিলের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে দায়রা আদালতে আপিল করতে হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ড দিলে সরাসরি দায়রা আদালতে আপিল করার বিধান রয়েছে একই আইনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক্ষেত্রে আপিল ফোরাম দুটির পরিবর্তে একটি হয়ে যায়। তার চেয়ে সংশ্লিষ্ট চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান রাখা হলে রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘব এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হতো। এতে আরো বলা হয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আইন বিষয়ে ডিগ্রি ও জ্ঞান নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপিল স্তরটি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করলেও অত্যুক্তি হবে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, জেলা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিবর্তে জুডিশিয়াল ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার হলে আপিলের একটি পর্যায় কমে আসবে। এতে বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সব পক্ষের জন্যই তা ভালো হবে।
এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের আরো কিছু ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করেছে আইন কমিশন। এটি সংশোধনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনটির ৯(২) ধারায় অর্থদণ্ড তাত্ক্ষণিক প্রদান করতে ব্যর্থ হলে তাত্ক্ষণিক কারাদণ্ড কার্যকরের বিধান রয়েছে। এতে জামিন-সংক্রান্ত কোনো বিধান নেই। কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধিতে এ বিষয়ে ৩৮৮ ধারা মোতাবেক আদালত চাইলে কিস্তিতেও অর্থদণ্ড পরিশোধ করার নির্দেশ দিতে পারেন। এছাড়া বন্ড গ্রহণ করে দণ্ডিতকে সাময়িকভাবে মুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে এ ধারা প্রযোজ্য নয়। আপিল করার সুযোগ পাওয়ার আগেই সাজা ভোগ করতে হয় বলে পরে আপিল করলেও তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আইনটিতে অতিসত্ত্বর উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন করা না হলে জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই এটি নিপীড়নমূলক একটি আইনে পর্যবসিত হবে।