ভারতের নির্বাচন কমিশন শনিবার জানিয়েছে, ১৯শে এপ্রিল থেকে পহেলা জুন পর্যন্ত লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে। ফলাফল ঘোষণা হবে চৌঠা জুন। লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে থাকে।
নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তির মধ্য দিয়ে প্রথম দফার নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র গ্রহণ শুরু হবে ২০শে মার্চ থেকে।
মোট সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে এবং প্রতিটি দফার জন্য পৃথক নোটিফিকেশন জারি করে আলাদা আলাদা মনোনয়ন পর্ব হবে। সারা দেশে একই সঙ্গে ভোট গণনা করা হবে চৌঠা জুন।
পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি দফাতেই ভোট গ্রহণ হবে। ওই রাজ্যে ১৯শে এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে শেষ দফায় ভোট নেওয়া হবে পয়লা জুন। কলকাতার দুটি আসনসহ রাজ্যের নয়টি আসনে ভোট ওই শেষ দফাতেই। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বিহার এবং উত্তর প্রদেশেও সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনও হবে।
জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তবে এবারও সেখানে বিধানসভা নির্বাচন করা হচ্ছে না।
নির্বাচনী তফসিল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনী আচরণ বিধি চালু হয়ে গেল দেশে।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম দফায় ১৯ শে এপ্রিল কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার আসনগুলিতে ভোট হবে। দ্বিতীয় দফার ভোট হবে ২৬শে এপ্রিল। সেদিন রায়গঞ্জ, বালুরঘাট আর দার্জিলিং-এ ভোট হবে। মালদা উত্তর এবং দক্ষিণ, মুর্শিদাবাদ আর জঙ্গিপুর আসনগুলিতে ভোট হবে তৃতীয় দফায় সাতই মে।
উত্তর বঙ্গ থেকে শুরু করে দফায় দফায় দক্ষিণ এবং পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে ভোট হবে।
চতুর্থ দফায় বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, বর্ধমান পূর্ব, বর্ধমান-দূর্গাপুর, আসানসোল, বীরভূম, বোলপুর কেন্দ্রগুলিতে ভোট হবে ১৩ই মে। পঞ্চম দফায় ২০শে মে তারিখে ভোট হবে শ্রীরামপুর, ব্যারাকপুর, বনগাঁ, দমদম , বসিরহাট, হাওড়া, উলুবেড়িয়া, হুগলি, আরামবাগ লোকসভা আসনে। ষষ্ঠ দফার ভোট ২৫শে মে। সেদিন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, কাঁথি, তমলুক, ঘাটাল কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে।
শেষ দফায় পয়লা জুন দমদম, বারাসত, বসিরহাট, জয়নগর, মথুরাপুর, ডায়মন্ড হারবার, উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, যাদবপুর আসনের জন্য ভোট হবে।
পশ্চিমবঙ্গে সাত দফা নিয়ে আপত্তি
ভোট ঘোষণার পরেই সাত দফায় পশ্চিমবঙ্গের ভোট গ্রহণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস।
দলের নেত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং শ্রমিক নেতা ঋতব্রত ব্যানার্জী সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তামিলনাডু, গুজরাতের মতো বড় রাজ্যগুলিতে যদি এক দফায় ভোট নেওয়া যায় তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কেন সাত দফায় ভোট নেওয়া হচ্ছে!
যদিও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারেও সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা বলেন এটা লোক দেখানোর জন্য করা হয়েছে, যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, দুটি বিজেপি শাসিত রাজ্যেও সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে।
তিনটি রাজ্যে সাত দফায় ভোট নেওয়া হলেও দেশের ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে এক দফাতেই ভোট হবে। দুই দফায় ভোট হবে চার রাজ্যে, দুটি রাজ্যে তিন দফায় ভোট গ্রহণ হবে।
আবার তিনটি রাজ্যে চার দফায় এবং দুটি রাজ্যে পাঁচ দফায় ভোট নেওয়া হবে।
কমিশনে যোগ দিয়েই ভোট ঘোষণা
শনিবার দুই নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার। অন্য দুই নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার এবং সুখবীর সিং সান্ধু মাত্রই একদিন আগে নির্বাচন কমিশনের কাজে যোগ দিয়েছেন।
কমিশনের এক সদস্য অনুপ পাণ্ডে ১৪ই ফেব্রুয়ারি অবসর নিয়েছিলেন আর গত সপ্তাহে হঠাৎ পদত্যাগ করেন আরেক কমিশনার অরুণ গোয়েল। তাই কার্যত একা মুখ্য নির্বাচন কমিশনারই দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন।
তাড়াতাড়ি করে দুই নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করা হয় বৃহস্পতিবার।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য যে কমিটি আছে, আগে সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থাকতেন। তবে কিছুদিন আগে নতুন আইন এনে বিচার ব্যবস্থাকে এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সব থেকে বড় বিরোধী দলের নেতা হিসাবে কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী রয়েছেন ওই কমিটিতে।
বৃহস্পতিবার যে নিয়োগ কমিটির বৈঠক হয়, সেখানে দুই নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগের ব্যাপারে মতানৈক্য লিখিত ভাবে জানিয়েছেন মি. চৌধুরী।
নির্বাচনের নির্ঘণ্ট যদিও আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তবে দুই নির্বাচন কমিশনারকে কাজে যোগ দেওয়ার পরের দিনই ভোট ঘোষণা করতে হল।
গত সপ্তাহে যে নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন, সেই অরুণ কুমার আসলে কেন ভোটের ঠিক আগেই দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেলেন, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যক্তিগত কারণ দেখালেও এরকমও বলা হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তার গুরুতর মত বিরোধ হয়েছিল।
নতুন দুই নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে জ্ঞানেশ কুমার ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অমিত শাহর হাতে থাকা দুটি মন্ত্রকে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পর্যায়ে কাজ করেছেন। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির সময়ে মি. কুমারই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘জম্মু-কাশ্মীর ডেস্ক’-এর প্রধান ছিলেন।
মি. সান্ধু ছিলেন উত্তরাখণ্ড রাজ্যের ‘লোকপাল’। তারও আগে সেই রাজ্যেরই মুখ্য সচিব ছিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রকেও যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসাবে কাজ করেছেন তিনি।
নারী ভোটার বেশি ১২টি রাজ্যে
ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা সঙ্গেই লোকসভা নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সংবাদ মাধ্যমকে দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার।
তিনি বলেছেন, “এ বার মোট ভোটারের সংখ্যা ৯৬.৮ কোটি। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৯.৭ কোটি এবং ৪৭.১ কোটি নারী। নতুন ভোটার হয়েছেন ১.৮২ কোটি।পুরুষ এবং মহিলা ভোটারদের অনুপাতে উন্নতি হয়েছে। দেশের ১২টি রাজ্যে পুরুষদের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি।’’
আবার নতুন যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮৫ লক্ষেরও বেশি নারী।
নির্বাচনের জন্য দু’হাজার একশো জন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হবে বলে কমিশন জানিয়েছে। এদের মধ্যে সাধারণ পর্যবেক্ষক, পুলিশ পর্যবেক্ষক এবং হিসাব পর্যবেক্ষকরা রয়েছে।
এবছরের ভোট গ্রহণ কেন্দ্র হবে সাড়ে দশ লক্ষ, দেড় কোটি ভোটগ্রহণ কর্মী থাকবেন।
ভোট নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে ৫৫ লক্ষ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম।
জম্মু-কাশ্মীরে এবারেও বিধানসভার ভোট হবে না
সিকিম, ওড়িশা, অরুণাচল প্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশ – এই চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনও হবে লোকসভার ভোটের সঙ্গেই।
এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সহ ১৩ টি রাজ্যের বিধানসভার ২৬টি আসনের উপ-নির্বাচনও হবে একই সঙ্গে।
তবে ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে না এখন হচ্ছে না। বর্তমানে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরে ছয় বছর আগে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার সাংবাদিকদের বলেন নির্বাচন কমিশন এই সপ্তাহেই জম্মু-কাশ্মীর সফরে গিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে।
তারপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে লোকসভা আর বিধানসভার ভোট সেখানে একই সঙ্গে করানো সম্ভব হবে না। লোকসভা ভোট মিটলে তারপরে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন করানো হবে।
“জম্মু-কাশ্মীরের সব রাজনৈতিক দলগুলি চাইছিল যে লোকসভার ভোটের সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচন হোক। কিন্তু প্রশাসনের সবার মত হল একসঙ্গে দুটি ভোট করানো যাবে না। প্রতিটা বিধানসভা কেন্দ্রের ১০-১২ জন করে প্রার্থী থাকবেন, তাদের প্রত্যেককে নিরাপত্তা রক্ষী দিতে হবে। তাই এখনই বিধানসভার ভোট করা অসম্ভব বলে তারা মনে করেন। তবে লোকসভার ভোটের পরেই ওখানে বিধানসভা ভোট করতে কমিশন প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ।“
জম্মু-কাশ্মীরে পাঁচটি লোকসভা আসন রয়েছে। সেখানে প্রতিটি আসনে ভোট নেওয়া হবে একেক দফায়, অর্থাৎ মোট পাঁচ দফায় লোকসভার ভোট হবে সেখানে।