অগ্রসর রিপোর্ট: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশছাড়া হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের সদস্য, প্রভাবশালী নেতা ও ঘনিষ্ঠজনরা ক্ষমতায় থাকতে ১৩ বিলিয়ন পাউন্ড তথা ১৩০০ কোটি পাউন্ড বিদেশে পাচার করেছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যেসব অর্থের বিনিময়ে বিদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও সম্পতি কেনা হয়েছে।
এর বেশিরভাগ অর্থ গেছে যুক্তরাজ্যে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরেও পাচার হয়েছে দেশের অর্থ। এক সাইফুজ্জামান চৌধুরী (সাবেক ভূমিমন্ত্রী) একাই মন্ত্রী থাকাকালে যুক্তরাজ্যে পাচার করেছেন ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
বিদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের এসব অর্থ-সম্পত্তির খোঁজে তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই বিদেশে বিনিয়োগের অর্থের উৎসের খোঁজে ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের সাহায্য চেয়েছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। মঙ্গলবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমস প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছে, হাসিনার শাসনামলে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে কমপক্ষে ২ লাখ কোটি টাকা বা ১৩০০ কোটি পাউন্ড বিদেশে সরানো হয়েছে— এই বিষয়ে সরকার তদন্ত করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ব্রিটিশ এই গণমাধ্যমকে বলেছেন, নতুন প্রশাসন তদন্ত করছে যে— শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি পাউন্ডের সমপরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা বিদেশে সরানো হয়েছে কি না। যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের সাবেক সরকারের সহযোগীরা সম্পদ গড়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এ ধরনের সম্পদ পাচার হয়ে থাকতে পারে। তিনি জানান, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে যে, সম্পদ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমটিতে আহসান এইচ মনুসর বলেছেন, তিনি এই বিষয়ে যেসব দেশের সাহায্য চেয়েছেন যুক্তরাজ্য তার একটি।
এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকার খুব সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। তিনি বলেন, দেশটির হাইকমিশনার আমার অফিসে এসেছিলেন এবং তারা ব্যাপক প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রীর মালিকানাধীন ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তির অর্থের তহবিলের উৎস শনাক্ত করতে চায়। এই সম্পদ যেন পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে তার জন্য আমরা যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে সাহায্য চাইব।
ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারাও বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই বিষয়ে তারা বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এ বিষয়ে তারা কথা বলবে না। এ নিয়ে তাদের পুরোনো নীতি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, নিজেদের দীর্ঘস্থায়ী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধ করা হয়েছে কি না সে বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করবে না।
শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীপ্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। যদিও বাংলাদেশের কঠোর মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ নীতি রয়েছে যার অধীনে নাগরিকেরা প্রতি বছর মাত্র কয়েক হাজার ডলার বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। এ বিষয়ে গভর্নর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অজান্তে এত ব্যাপক আকারের চুরি সংঘটিত হতে পারে না। তবে এই বিষয়ে হওয়া তদন্তগুলো এখনো ‘বেশ প্রাথমিক পর্যায়ে’ রয়েছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত মাসে ভারতে চলে যান। কিন্তু ওই দেশে তার অবস্থান ঠিক কোথায় তা অজানা এবং এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি বলছে, (বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আসা) এই অভিযোগগুলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের নতুন লেবার সরকারের জন্য জটিল সমস্যাজনক বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
কারণ, ব্রিটেনের নতুন এই লেবার সরকারের সিটি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি। যদিও টিউলিপ সিদ্দিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এমন কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। আবার এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অনুরোধে জবাবও দেননি টিউলিপ সিদ্দিক।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের কাছেও সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ‘বাংলাদেশ থেকে চুরি করা এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধার করতে যাচ্ছে। এটি এই সরকারের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি।’
এতে আরও বলা হয়, ১৭ কোটি মানুষের দেশ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশে শেখ হাসিনা দুই দশক ক্ষমতায় ছিলেন। ভোটে কারচুপি, অধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে তার সরকার অভিযুক্ত ছিল এবং সর্বশেষ গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে তার সরকারের পতন হয়।
হাসিনার দল আওয়ামী লীগের মিত্রদের বৈদেশিক সম্পদের বিষয়টি বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-ইউকে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলোর মালিকানাধীন ব্রিটিশ রিয়েল এস্টেট পোর্টফোলিওকে ‘অব্যক্ত সম্পদের’ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছিলেন, কর্তৃপক্ষের বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম ব্লুমবার্গের বিশেষ এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই রাজনীতিবিদের অবৈধ সম্পদের বিশাল সাম্রাজ্যের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০ টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য।
যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল।
এমনকি সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। যুক্তরাজ্য ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, যুক্রাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ায়ও রিয়েল স্টেট ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন তিনি। নিজের ও স্ত্রীর নামে সবমিলিয়ে প্রায় ৫০০ বাড়ি আছে আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রীর। বাংলাদেশি টাকায় যেগুলোর মূল্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বা ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাজ্যের ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এসব সম্পদ ২০১৬ সালের পর থেকে কেনা। বেশির ভাগ সম্পদ কেনা হয়েছে ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। যখন সাইফুজ্জামান চৌধুরী শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন।
এর মধ্যে সেন্ট্রাল লন্ডনের ফিটজরোভিয়ার এমারসন বেইনব্রিজ হাউস, ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের ৬১টি সম্পত্তি এবং ব্রিস্টলের একটি কো-অপ সুপারমার্কেটের সাইটও রয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যে তার সম্পত্তি ক্রয়ের পেছনে অর্থায়ন কী ছিল তা অস্পষ্ট।
এসব বিষয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, তার মক্কেলের ‘লুকানোর কিছু নেই’ এবং তিনি কিছু চুরি করেননি। আইনজীবী বলেন, ‘সাইফুজ্জামান চৌধুরী একজন চতুর্থ প্রজন্মের ব্যবসায়ী, যিনি রাজনীতিতে আসার আগেই ১৯৯০-এর দশকে তার সম্পদ অর্জন শুরু করেন।’
সাইফুজ্জামান চৌধুরীও এমন দাবি করেছিলেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশে থাকা তার এসব সম্পদ এসেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে।’
এদিকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে সাইফুজ্জামানের আইনজীবী আজমালুল হোসেন আরও বলেন, ‘ড. ইউনূসের ‘‘অসাংবিধানিক সরকার’’ আওয়ামী লীগ সদস্য ও নেতাদের নিপীড়ন করছে। যথেষ্ট আশঙ্কা আছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।’
এদিকে শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত ব্রিটিশ এই গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সহযোগীরা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। তিনি আরও বলেন, ‘(নতুন সরকার) সব কিছুকে বড় দুর্নীতি হিসেবে দেখাতে চাইছে। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দোষী করতে চাইছেন। তবে এটা ভালো যে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা হচ্ছে …এসব অভিযোগ তাদের প্রমাণ করতে হবে।’
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ একাদশ সংসদে ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। তবে সংসদীয় জমি সংক্রান্ত কমিটির সভাপতির পদে ছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ক্ষমতায় থাকতে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নির্বাহী কমিটি চেয়ারম্যানের পদ জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগ ছিলো। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান শরীফ জহীরের বাবা মো. হুমায়ুন জহির। সরকার পতনের পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিরুদ্দেশ হলে ব্যাংকটির পূর্বের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।