স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার পরিবর্তন হলেও কেউ যেন দেশে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য দেয়া ফেলোশিপকে বন্ধ করতে না পারে সে লক্ষ্যে সরকার বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপকে একটি ট্রাস্টে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এখন অনেক সতর্ক। আমরা ভাল কাজ করে গেলেও সরকার পরিবর্তন হলে দেশের প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে অন্য সরকার এসব কাজ বন্ধ করে দিতে পারে।…অতীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার এমন অনেক প্রকল্পই বন্ধ করে দিয়েছিল।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ শুরু করা বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।
তিনি বিশেষায়িত জ্ঞানের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলারও আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এনএসটি) ফেলোশিপ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় নিয়োজিত গবেষকদের মাঝে বিশেষ অনুদানের চেক বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ আহবান জানান।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ওপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো.সিরাজুল হক খান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে এ বছর ৫০ জন এম.এস, ১৬০ জন পিএইচডি, ১১ জন পোষ্ট ডক্টোরাল স্টুডেন্ট এবং গবেষককে দেশে-বিদেশে উচ্চ শিক্ষা-গবেষণার জন্য ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দেখি-গবেষণা খাতে কোন বরাদ্দ নেই। সে বছরই গবেষণার জন্য ১২ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেই। এখন সারা বছরই তরি-তরকারি পাওয়া যাচ্ছে, এটি সে সময়কার বরাদ্দে কৃষি গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি সেসব প্রজেক্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। যারা বিদেশে গবেষণা করছিলেন, তাদের গবেষণাও বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে আবার সেসব প্রকল্প চালু করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী, আমাদের চেয়েও বেশি মেধাবী। তারা এই যুগের ডিজিটাল বাচ্চা হিসেবে বড় হচ্ছে।.. জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া, শিক্ষিত জাতি ছাড়া এদেশ কোনো দিন উন্নত হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আজকের যারা শিশু, তারাই আগামী দিনে কর্ণধার হবে। আর সেটা হতে হবে আরো বেশি শিক্ষিত হয়ে, জ্ঞান অর্জন করে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই অন্য কোনো দিকে মন না দিয়ে, শিক্ষার্থীদের সবার আগে লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার দিকে মন দেয়ার মাধ্যমে বহুমুখি প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ২০৪১ সালে আমাদের নতুন প্রজন্ম যেন উন্নত জীবন পায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছি আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি হোক, দেশ আরো এগিয়ে যাক-সেই প্রত্যাশাই করছি।
স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনে আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন দেশেও তিনি শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। স্বাধীন দেশের সংবিধানেও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। এই কমিশনের রিপোর্টে দেশ গঠনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে গবেষণার উপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের পরে জাতির পিতাহীন বাংলাদেশে সেই কমিশনের সুপারিশ আর বাস্তবায়িত হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই শিক্ষানীতির আলোকেই নতুন শিক্ষানীতি করেছি। আমরা শিক্ষাকে বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাশাপাশি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাপড়ার আগ্রহ কমে গিয়েছিলো। আমরা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের সেই আগ্রহ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য আগে বৃত্তি দেয়া হয়নি। আমরা সে বৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বতন্ত্র ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি -২০১১’ প্রণয়ন করেছি। দু’টি নীতিতেই আমরা জাতির পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করেছি। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সাইন্স এন্ড আইসিটি’ প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার ও ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনে এই ফেলোশিপ সহযোগিতা করছে। এমএসএস এবং পিএইচডি ডিগ্রীর মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও গবেষক তৈরিই এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রকল্প মেয়াদ জুলাই ২০১০ থেকে ডিসেম্বর ২০১৬। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৮৫ কোটি ৯৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সাইন্স এন্ড আইসিটি’ প্রকল্পের আওতায় বিদেশে ৫০ জন এমএস, ৬০ জন পিএইচডি, দেশে ১০০ জন পিএইচডি এবং ১১ জন পিএইচডি উত্তর গবেষণা ফেলোশিপ পেয়েছেন। ইতোমধ্যে বিদেশে ৩৭ জন এমএস, ৩০ জন পিএইচডি এবং দেশে ৩৮ জন পিএইচডি ও ৮ জন পিএইচডি উত্তর কোর্সে গবেষণা কার্যক্রম শেষ করেছেন।
মন্ত্রণালয় এমফিল, পিএইচডি ও পিএইচডি উত্তর শিক্ষার্থীদের ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’ দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৭২ জন তরুণ গবেষকের মধ্যে ৩১ কোটি ২০ লাখ ২৬ হাজার টাকা ফেলোশিপ দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৪৩৮ জন গবেষককে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩০০ টাকা দেয়া হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় প্রণোদনা হিসেবে মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুদানের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৭২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা গবেষণা অনুদান দিয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে ৩৯০টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১২ কোটি ৮ লাখ টাকা দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এখন বিশেষায়িত জ্ঞানের যুগ। বহুমাত্রিক জ্ঞানের পাশাপাশি বিষয় ভিত্তিক বিশেষ জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। এজন্য চট্টগ্রামে মেরিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন ও ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী উচ্চশিক্ষার প্রসারে তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের খ-চিত্র তুলে ধরে বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে বিশ্বটা কিন্তু হাতের মুঠোয়। আমরাও তার সুফলকে কাজে লাগাচ্ছি।
তিনি বলেন, ৭শ’ ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ‘উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আমরা ৩৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বজ্ঞান ভান্ডারের সাথে সংযুক্ত হয়েছি। ভার্চুয়াল প্রযুক্তিতে বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং উচ্চশিক্ষার ডিজিটাল পুস্তক ও জার্নাল সহজলভ্য করেছি। ইউজিসি ২৬৭ জনকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী, ১৩৮ জনকে এম.ফিল এবং ২১ জন শিক্ষককে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ দিয়েছে। গবেষণার জন্য সার্ক ফেলোশিপ, রোকেয়া চেয়ার ও ইউজিসি প্রফেসরশীপ প্রবর্তন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে গবেষণা প্রণোদনা প্রকল্প ৪৯৭টি থেকে ১ হাজার ২৮২টি করেছি। উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ৮৯৬ কোটি ২৬ লাখ থেকে ২ হাজার ১১৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউএসডিএ ও জাইকার অর্থানুকূল্যে ২২শ’ কোটি টাকার ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে
প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ প্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা জ্ঞানের উচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন অথবা পৌঁছবেন, তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিক চেতনা বোধ থাকা চাই। কারন, আপনাদেরকে দেশবাসীর সামনে ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরতে হবে-কারা, কেন জাতি-রাষ্ট্রের স্থপতিকে, নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে। ৭১’র ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কারা-কেন হত্যা করেছিল ?
তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সঙ্গে সকলের দেশাত্মবোধ, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ নাগরিক হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, এটাই আমরা চাই। জ্বালাও-পোড়াও আমরা চাই না। আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ হিসেবে গড়া তোলা।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।