দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, আশির দশকে তা স্তিমিত হয়ে আসে। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচভ ক্ষমতা গ্রহণের চার বছরের মাথায় ক্রেমলিনের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ১০ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। গর্বাচভ তখন আর্থিক নীতি শিথিলের উদ্যোগ নেন। বাজার সংস্কার মেনে নেয়ার শর্তে তিনি ভারী শিল্প ও কৃষি খাতকে কিছু ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি দেন। মিখাইল গর্বাচভের এ উদ্যোগ ছিল স্রেফ জুয়াবাজি। তিনি ভেবেছিলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনার পথ ছেড়ে ঘাটতি-অর্থায়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতের প্রসার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ঋণ বাজারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় বর্ধিত ব্যয় অর্থায়নে নতুন নোট ছাপানো ছাড়া তার উপায় ছিল না। এতে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়তে থাকে এবং রুবলের মানে ধস নামে।
এদিকে পণ্যমূল্য যেহেতু সরকার নির্ধারণ করত, তাই সোভিয়েত বাজারগুলো নতুন আর্থিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। এতে বাজারের স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়। কোথাও অতি সরবরাহ, আবার কোথাও সংকট দেখা দিতে থাকে। আশির দশকের শেষে এসে সোভিয়েত নাগরিকরা রুটি, দুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় যাদেরই কালোবাজারে বিক্রির সুযোগ ছিল, তারা সে পথে নেমে যান। যেসব প্রতিষ্ঠানের কালোবাজারে কেনাবেচার সুযোগ ছিল না, সেগুলোকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়।
১৯৮৯ সাল নাগাদ সোভিয়েত অর্থনীতি মন্দার দিকে ঝুঁকতে থাকে, যদিও তখন কালোবাজারে পণ্যমূল্য আকাশ স্পর্শ করে। ১৯৯১ সাল নাগাদ অর্থনীতিতে ফাটল দেখা দেয়। করারোপ ও সরকারি ব্যয়ের মতো বিষয়গুলো ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
১৯৯৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভ্লাদিমির পুতিন একটি রক্ষণশীল সামস্টিক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করে আসছেন। এ কারণেই তিনি এমন অনেক সংকট উতরে গেছেন যেখানে পর্যবেক্ষকরা ভেবেছিলেন, তার সরকারের পতন হবে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তেলের মূল্য পতন হতে থাকে। একই সময় পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পুতিন তখন বিরাট কৃচ্ছ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বাজেট ভারসাম্য রক্ষায় তিনি সামাজিক কর্মসূচি ও পেনশন ব্যয় হ্রাস করেন। ব্যাংক অব রাশিয়া সুদহার বাড়িয়ে দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যায়। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে পড়ে। উদীয়মান একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতির এ হারকে সম্মানজনক বলতে হবে।
রাশিয়ার সরকারি আয়ের অর্ধেক আসে তেল বিক্রি থেকে। দুই বছর আগের তুলনায় তেল এখন অর্ধেক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। তার পরও রাশিয়ার বাজেট ঘাটতি এ বছর জিডিপির ৩ শতাংশের সামান্য উপরে বাঁধা থাকবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২০ শতাংশের কম। সে তুলনায় ফেডারেল রিজার্ভ জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণ জিডিপির ৭৫ শতাংশেরও বেশি। পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার বড় কোম্পানিগুলো বিদেশী মুদ্রায় প্রয়োজনীয় পুঁজি আকর্ষণ করতে পারছে। কমোডিটি বাজারে ধস এলেও রাশিয়ার তেল উত্পাদনের পরিমাণ এখন সোভিয়েত-পরবর্তী যুগের সর্বোচ্চ। ইউক্রেন ও সিরিয়ায় সামরিক ব্যয় বাড়লেও রাশিয়ার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি তাতে ব্যাহত হচ্ছে না।
পুতিনের ক্ষমতা গ্রহণের আগে রুশ অর্থনীতিতে সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, এখন তা অনেকে বেড়েছে। শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নয়, তেলসহ অর্থনীতির অনেক খাত এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে। বেতন প্রবৃদ্ধির গতিও সন্তোষজনক। দেড় দশকের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জোরে রুশ সরকার এখন ঘরে-বাইরে যেকোনো রকম সম্পদ ও সামর্থ্য মোতায়েনের সক্ষমতা রাখে।