পাপ বাপকেও ছাড়ে না—এই কথাটি আবারও প্রমাণিত হলো। সিলেটের এমসি কলেজে একজন গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচার দাবি করেছে স্বয়ং তাদের পরিবারও। অভিযুক্তদের পরিবার থেকে বলা হয়েছে, তাদের সন্তানদের বখে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক নেতা ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দায় আছে। একজন অভিভাবক প্রচার মাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি এমন একজন হতভাগ্য যে, ছেলের পরিচয় দিতে ভয় পাচ্ছি। তবে আমার ছেলেটা আগে এমন ছিল না।’
আমাদের দেশে ধর্ষণ যেন একটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক বললাম এই কারণে যে, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারী ধর্ষিতা হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক হইচইও হচ্ছে। যেন ভরাট পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো অবস্থা। ঢিল যদি ছোট হয় তাহলে ছোট ঢেউ ওঠে। ঢিল বড় হলে অনেক বড় ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ে পুকুরের পানি চারদিকে সরে যায়। আবার কিছুক্ষণ পরই পুকুরের ঢেউ মিলিয়ে যায়। পানি স্বাভাবিক হয়। যেন কিছুই হয়নি। ধর্ষণও তেমনই ঢিল ছোড়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে। চারদিকে হইচই শুরু হয়। তখন মনে হয় এই বুঝি কাজের কাজ কিছু একটা হবে। ধর্ষণকারীরা সাজা পাবে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে অথবা রাজনৈতিক চাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের কিছুই হয় না। ছেলে ধর্ষণ করেছে জেনেও বাবা-মায়েরা ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কেউ কেউ দোষী ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বাতাসেও টাকা ছড়াতে শুরু করে। ছেলে হোক ধর্ষণকারী। কিন্তু সে তো আমার রাজপুত্র। কোনোভাবেই রাজপুত্রের ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। বাবা-মায়ের এমন মানসিকতায় শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ ধর্ষণ মামলা হয় খারিজ হয়ে যায়, না হয় নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।
তবে আশার কথা এই প্রথম ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছে তাদেরই পরিবার। একজন বাবা বলেছেন, ‘ছেলের পরিচয় দিতে ভয় পাচ্ছি। এক্ষেত্রে ভয়ের চেয়ে লজ্জাই বোধকরি বেশি কাজ করছে।’
এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, তাদের ছেলেরা অপরাধী ছিল না। ভালো ছাত্র ছিল। ছেলেদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ পাঠিয়েছেন তারা। সেখানে রাজনীতিতে জড়িয়ে এবং সঙ্গ দোষে তাদের ছেলেরা বিপথগামী হয়েছে। এর দায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। অভিভাবকরা খুবই যুক্তিযুক্ত কথা বলেছেন। বাবা-মায়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানকে পাঠান মানুষের মতো মানুষ করার জন্য। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসার পর ছেলেরা যখন বিপথগামী হয়, তখন এর দায় কার? রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মূলত একজন নিরীহ ছাত্র এক সময় হিংস্র, অপরাধী হয়ে যায়। এক্ষেত্রে স্ব-স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও দায় এড়াতে পারেন না। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ, হলও বন্ধ থাকার কথা। সেখানে এমসি কলেজের হলে ছাত্র অথবা ছাত্র নামধারীরা কী করে হলে থাকার সুযোগ পেলো? কয়েকটি টিভি চ্যানেলে এমসি কলেজের অধ্যক্ষের সাক্ষাৎকার দেখলাম। বন্ধ ক্যাম্পাসে কীভাবে ছাত্র নামধারীরা হলে থাকার সুযোগ পেলো? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব তিনি দিতে পারেননি। একটি কলেজ যদি হয় একটি পরিবার, তাহলে ওই পরিবারের প্রধান হলেন অধ্যক্ষ। তারই তো জানার কথা, তার পরিবারের কোন ঘরে কে থাকে। অথবা তার পরিবারে কে আসে কে যায়, এটাও তো তার জানার কথা। এবং কোনও ঘরে অন্যায়, অবৈধ কিছু হতে থাকলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থাতো তাকেই করতে হবে। এমসি কলেজের অধ্যক্ষ কেন এই ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলেন? অভিযোগ রয়েছে, সিনিয়রিটি ব্রেক করে তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছেন। আর তাই কলেজে কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে থাকেন।
পরিবার প্রধান যদি দুর্নীতিবাজ হয় তাহলে ওই পরিবারে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য চর্চাই হবে বেশি। এমসি কলেজের ঘটনা এ কথাই আবার প্রমাণ করলো।
এবার আসি অভিভাবকদের কথায়। সিলেটে ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের বিচার চেয়েছে অভিযুক্তদের পরিবার। এটা শুভ লক্ষণ। প্রতিবাদ এবার পরিবার থেকেই শুরু হয়েছে। কয়েকজন অভিভাবক বলেছেন, তাদের ছেলেরা অনেক ভালো ছাত্র। কিন্তু কলেজে ঢোকার পর খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ কথা কি তারা বাধ্য হয়ে বলছেন? ছেলেদের অপকর্মের ঘটনায় যখন চারদিকে ছিঃ ছিঃ রব পড়েছে, তখন তারা মুখ খুললেন কেন? তাদের আদরের যুবরাজেরা নিশ্চয়ই একদিনে বিপথে যায়নি? এজন্য নিশ্চয়ই সময় লেগেছে। আদরের পুত্র কলেজে ভর্তি হলো, আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকলো। পড়াশুনার চেয়ে সন্ত্রাসের দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে আদরের সন্তান। তখন কেন বাবা-মায়েরা মুখ খুললেন না? নাকি সন্তানদের বদলে যাওয়ার পেছনে বাবা-মায়েদেরও দায় আছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে একজনের বাবার সঙ্গে তোলা ছবি ভাইরাল হয়েছে। পিতা-পুত্র পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছেন। দু’জনের মাথায় টুপি। বাবার সঙ্গে এমন শ্রদ্ধা জড়ানো ছবির ছেলেটি কেন অপরাধী হয়ে গেলো? এজন্য কি পরিবারের কোনও দায় নেই। বাবারও কি কোনও দায় নেই? ছেলে যে দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে, অপরাধী হয়ে যাচ্ছে…তা কি তিনি বুঝতে পারেননি? অথবা এমনও হতে পারে ছেলের বদলে যাওয়ার পেছনে প্রচ্ছন্ন কোনও সমর্থন ছিল? হোক ছেলে সন্ত্রাসী, তাকে তো দেখি অনেকেই পাত্তা দেয়, সমীহ করে। ছেলে তো দেখি না চাইতেই টাকা পয়সাও দেয়। ক্ষতি কী, এমন সোনার ছেলেই তো দরকার?
প্রিয় পাঠক, বলছি না সব বাবা-মাই এমনটা ভাবেন! তবে পরিবারের ভদ্র, নম্র ছেলেটির সন্ত্রাসী হয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারও দায় এড়াতে পারে না। আবার দায় এড়াতে পারে না রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও। একথা সত্য, আমাদের দেশে সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কোনও না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। সিলেটের ঘটনায়ও সন্ত্রাসীদের বেড়ে ওঠার পেছনে পরোক্ষভাবে হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। এমসি কলেজের ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতদের বিচার চাইছে সিলেটের রাজনৈতিক মহলও। যদি প্রশ্ন করি, এতদিন তারা কী করেছেন? একদল ছাত্র সন্ত্রাসী হয়ে গেলো, সেটা কি একদিনে হয়েছে? রাজনৈতিকভাবে কারও না কারও তো প্রশ্রয় ছিল। শুধু সিলেটের এমসি কলেজে নয়, দেশের অধিকাংশ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ‘সন্ত্রাসী’ তৈরির লোমহর্ষক চর্চা চলছে অনেকটা প্রকাশ্যেই। এরা দল বোঝে না। নীতি, নৈতিকতার ধার ধারে না। এরা শুধু বোঝে প্রভাব-প্রতিপত্তি। পরিচয়ে রাজনৈতিক লেবেল এঁটে দিনের পর দিন এরাই অন্যায়, অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তুলছে অথবা গড়ে তুলতে গডফাদারদের সহায়তা করছে।
এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ডের পর দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নাম বারবার উঠে আসছে। ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে এক্ষেত্রে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তার মতে, এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে জড়িতরা কোনোভাবেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নয়। তারা ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। লেখক ভট্টাচার্যের কথাই যদি সত্য বলে ধরি তাহলে একটি সহজ প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। এমসি কলেজের মতো দেশসেরা একটি কলেজে সন্ত্রাসীরা দিনের পর দিন ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অন্যায়, অশোভন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল। ছাত্রলীগ কি তা জানতো না? জেনে থাকলে কেন কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেয়নি? আর যদি না জেনে থাকে, তাহলে কি এটা তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা নয়? দেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ছাত্র সংগঠনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে সেই সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে এটাতো হতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করুন বা নাই করুন গত কয়েক মাসে স্পর্শকাতর অনেক নিন্দনীয় ঘটনার পর দেশের ছাত্র সংগঠনগুলো আবার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রতি চাপটা পড়েছে বেশি। এর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে অভিভাবকদেরও একটা দায় আছে। সন্তানকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন, আর ভাবলেন দায়িত্ব বুঝি শেষ! আপনার সৎ, চরিত্রবান ছেলেটি কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যখন দেখবেন পড়াশুনার চেয়ে অবৈধ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন চুপ করে থাকবেন না। তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। না হলে একদিন দেখবেন পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়বে না…
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।