অগ্রসর রিপোর্ট : পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাট ও পাটপণ্যের রফতানির জন্য প্রণোদনা সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাট শিল্প টেকসই করতে এ খাত লাভজনক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় পাট দিবস-২০১৯ এবং বহুমুখী পাটপণ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাট এমন একটি পণ্য যার কিছুই ফেলনা নয়, অতএব কেন এতে লোকসান হবে, আমি কোন লোকসানের কথা শুনতে চাই না বরং পাটশিল্প কিভাবে লাভজনক হতে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, নতুন পণ্যের উদ্ভাবনার মাধ্যমে আমরা এই খাতকে লাভজনক করতে পারবো। যারা হতাশাপূর্ণ আমি তাদের মধ্যে নেই, আমি সর্বদা আশাবাদী।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সব সময় এই খাতের উন্নয়নে সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে আমরা চাই বেসরকারি খাত এই খাতের প্রতি আরো গুরুত্ব দিক। বেসরকারি খাত এই খাতে যতো বেশি গুরুত্ব দেবে পাটশিল্প ততোই বিকশিত হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে অন্যান্য খাতে উদ্দীপক সুবিধা দিচ্ছে। পাটখাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এই সুবিধা দেয়া হবে, যাতে তারা আরো বেশি পাটপণ্য রফতানি করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য রফতানিমুখী পণ্য যে ইনসেনটিভ পাচ্ছে, পাটপণ্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ইনসেনটিভ দেয়া হবে।’
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম। মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মিজানুর রহমান স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্ঠাগণ, সংসদ সদস্যগণ, বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ এবং উর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আজ দেশ্যব্যাপী পাট দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের পাট দিবসের স্লোগান হচ্ছে ‘ সোনালী আঁশের সোনালী দেশ, জাতির পিতার বাংলাদেশ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই অন্যান্য কৃত্রিম আঁশের স্থান দখল করে পাটের যাত্রা শুরু। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে মিশ্রণ করে একে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া, এ আঁশ পচনশীল বিধায় পরিবেশের ক্ষতি করে না। তিনি বলেন, পাট এক সময় আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ছিল। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ছিল পাটের সম্পৃক্ততা। ছয়দফা আন্দোলনের ঘোষণায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে পাটের অবদানের বিষয়টি তুলে ধরেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারেও পাট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৯০ ভাগ আসত পাট খাত থেকে। কিন্তু কিছুটা কৃত্রিম আঁশের আগ্রাসনের ফলে আবার কিছুটা ৭৫-পরবর্তী সরকারগুলোর অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের দেশের পাট খাতে মন্দা নেমে এসেছিল।মাঝে কিছুটা সময় পাটের মন্দ সময় গেলেও এখন নতুন করে পাট শিল্পের সুদিন ফিরে আসছে। সারাবিশ্বের মানুষ ক্ষতির দিক বিবেচনায় নিয়ে কৃত্রিম আঁশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার পাটের মত প্রাকৃতিক আঁশের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। এ খাতে গবেষণা বাড়াতে হবে। পাটের রপ্তানি বাড়াতে নতুন-নতুন বাজার ধরতে হবে।
তিনি বলেন, দেশে পাট উৎপাদন ও পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পরিবেশ রক্ষায় আমরা ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ ও ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’ প্রণয়ন করেছি। সরকার ইতোমধ্যে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, ও মসলা জাতীয় পণ্যসহ ১৯টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। এই আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবছর প্রায় ১৫০ কোটি পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যকে বহুমুখী করার বিষয়টিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০ জন বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। ওই সকল উদ্যোক্তা প্রায় ২৮০ ধরনের পাটের পণ্য তৈরি, বাজারজাত এবং রপ্তানি করছে।
তিনি বলেন, পাটের সূতা, বস্তা, চট, কার্পেট ইত্যাদি প্রচলিত পণ্যের পাশপাশি পাট দিয়ে পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, শাড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা যায়। পাট খড়ি থেকে উন্নতমানের কার্বন তৈরি হচ্ছে। পাটের আঁশ থেকে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি তৈরি সম্ভব। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মন্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাট খড়ি ব্যবহৃত হয়।সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যা দিয়ে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করা হচ্ছে। সোনালি ব্যাগের ব্যবহার দ্রুত প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ‘রপ্তানি নীতি ২০১৮-২০২১’ ঘোষণা করেছি। এর আলোকে পাটজাত পণ্যের মান উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণের জন্য পণ্যভিত্তিক শিল্প এলাকা গড়ে তোলার জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, সোনালী আঁশ পাটকে বিশ্বব্যাপি ব্রান্ডিং করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন জোরদার হওয়ায় পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে। পাট চাষ সম্প্রসারণ এবং অধিকহারে পাটপণ্য ব্যবহার করে আমরা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেন, শিল্পখাত বিবেচনায় পাটশিল্প এখনও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাঁচা পাট, প্রচলিত পাটপণ্য এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় ১০২৫.৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০৫-০৬ অর্থবছরে পাটখাত হতে রপ্তানি আয় হয়েছিল মাত্র ৪৩০.৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীসহ বেশ কয়েকটি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল। এতে মিলের প্রায় ২৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বন্ধ পাটকলসমূহ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা ৫টি বন্ধ পাটকল চালু করেছি। এরফলে প্রায় ১০ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কৃষি ও শিল্প প্রধানত: এই দুটো খাতের সমন্বয়ে পাট খাত। কৃষকেরা পাট উৎপাদন করে থাকেন আর উৎপাদিত পাট ব্যবহৃত হয় শিল্পখাতে। কাজেই পাট খাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য কৃষি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। আমরা ততটুকুই পাট উৎপাদন করব যতটুকু আমরা ব্যবহার করতে পারব। এই ব্যবহারের মধ্যে রপ্তানিও থাকবে।
তিনি বলেন, এর আগে আমরা লক্ষ্য করেছি, অতিরিক্ত পাট উৎপাদন করে চাষীরা লোকসানের মুখোমুখী হয়েছেন। আবার কম উৎপাদন হওয়ায় আমাদের পাট পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদা ঠিক করে উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। তাহলেই কৃষক এবং পণ্য উৎপাদনকারী কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে পাটকলগুলোকে লাভজনক করতে হবে। পাট চাষীদের তাঁদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। পাট ব্যবসায়ীদের টাকাও সময়মত পরিশোধ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে পাটের হৃত গৌরব আবার ফিরে আসবে। তিনি পাট মন্ত্রণালয়, বিজেএমসি, বিজেসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তরকে এ ব্যাপারে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০২৩-২৪ সাল নাগাদ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। এ সময়ে আমরা মাথাপিছু আয় ২,৭৫০ মার্কিন ডলার এবং রপ্তানি আয় ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।
তিনি বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে একদিকে প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ, অন্যদিকে আমাদের পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা বহুমুখীকরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাটজাত পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি মনে করি। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই আমরা সফলকাম হতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আসুন, লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভূমিকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলি।
‘সোনালি আঁশ’-পাটের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করব- এ প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পাট দিবস-২০১৯ এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত বহুমুখী পাটপণ্যের মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
পাটখাত বিকাশের লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তৃতীয়বারের মত জাতীয় পাট দিবস পালিত হচ্ছে। এ বিশেষ দিবসে পাট চাষ এবং পাট পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত সকলকে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট আমাদের সোনালি আঁশ। পাটের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করার জন্য ৬-ই মার্চকে জাতীয় পাট দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমি আশা করি এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে পাটখাতের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকলে একযোগে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হবেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী পাট খাতের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৪টি পুরষ্কার তুলে দেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী বিআইসিসি চত্বরে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।