বিষেশ প্রতিনিধি- দেশে আমিষের চাহিদার ৬০ শতাংশ জোগান আসছে মাছ থেকে। মোট দেশজ উৎপাদনে খাতটির অবদান এখন ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ বা দেড় কোটির ওপর লোক পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও এর সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগছে না। অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় অপচয় হচ্ছে উৎপাদিত মাছের ৩০ শতাংশ যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১১ লাখ টন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য অধিদফতরের নিজস্ব গবেষণা ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে মাছ অপচয়ের তথ্য জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে— পচনশীল দ্রব্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন মাত্রায় এসব মাছ নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে। অপচয়ের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রজাতির এবং আকারের পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া মাছ নষ্ট হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী পরিবহন এবং সংরক্ষণে অদক্ষতা। সঠিক মাত্রায় পরিবহন এবং সংরক্ষণ করতে না পারায় ১৫-১৭ শতাংশ মাছ নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া খুচরা ও পাইকারি বাজারের বিক্রেতাদের অদক্ষতার কারণেও মাছ নষ্ট হচ্ছে। আবার ভোক্তা পর্যায়ে মাছটি আনার পর এর উচ্ছিষ্টাংশ ফেলে দেয়া হয়। এখানেও বাদ পড়ে মাছের ২-৫ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাছের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যপণ্য উৎপাদন হলেও বাংলাদেশে তার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এ ধরনের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে তেল, অয়েল কেক ও খাবার তৈরি এবং শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল তৈরি করে বছরে বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব।
অথচ মাছ উৎপাদনে গর্ব করার মতো সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য গ্লোবাল অ্যাকুয়াকালচার প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকস ফর দি ইয়ার-২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, চাষকৃত মাছ উৎপাদনে (ফিশ অ্যাকুয়াকালচার) শীর্ষ পাঁচে বাংলাদেশ। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পরই অবস্থান বাংলাদেশের। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সম্প্রসারণ হারও বেশি। কিন্তু অপচয়ের কারণে মাছের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। দেশে এখনো একজন মানুষের বছরে মাছের ঘাটতি রয়েছে প্রায় আড়াই কেজি। অর্থাত্ প্রতি বছরে এখন ঘাটতি প্রায় চার লাখ টন। আর ১০ লাখ টন অপচয় হিসেবে নিলে তা প্রকৃতপক্ষে হবে প্রায় ১৪ লাখ টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছ উৎপাদন বাড়াতে সরকার যতটা নজর দিয়েছে, ঠিক ততটাই অবহেলা করা হয়েছে এর সংরক্ষণ কিংবা পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে। তাছাড়া মাছ উৎপাদনে জড়িত এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় যারা নিয়োজিত, তাদেরও দক্ষতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাজা মাছ বিপণন করতে দেশে গড়ে ওঠেনি উন্নত অবকাঠামো। খামারি বা জেলেরা এখনো পুরনো পদ্ধতিতে মাছ বিপণন করে যাচ্ছেন।
‘পোস্ট-হারভেস্ট লস রিডাকশন ইন ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ: এ ওয়ে ফরোয়ার্ড টু ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মোট উৎপাদিত মাছের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ তাজা হিসেবে পাচ্ছেন ভোক্তারা। আবার দেশে ৪০ শতাংশ মাছের বরফ প্রয়োজন হলেও তা ব্যবহার করছেন না সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ জেলে, ৭৭ শতাংশ খামারি বা কৃষক, ২৭ শতাংশ রিটেইলার এবং ৪৭ শতাংশ ভেন্ডররা মাছে বরফ ব্যবহার করছেন না।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের কৃষকদের যেমন প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবও মাছের অপচয়ের জন্য দায়ী। তাছাড়া মাছের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান উপজাত তৈরি হলেও দেশে তা সম্ভব হচ্ছে না। আবার পরিবহন ব্যবস্থারও দুর্বলতা রয়েছে। তিনি জানান, মন্ত্রণালয় থেকে মাছের অপচয় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এজন্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে নীতিসহায়তা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৫ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। এর সিংহভাগই বদ্ধ জলাশয়ের। পুকুর, আধা-বদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় এবং চিংড়ি খামারে উৎপাদিত হচ্ছে ৪৮ শতাংশ মাছ। এছাড়া মুক্ত জলাশয় বা নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক এবং প্লাবন ভূমিতে উৎপাদন হচ্ছে ৩৪ শতাংশ। আর সামুদ্রিক মাছের অবদান ১৮ শতাংশ। তবে উৎপাদিত এসব মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে কার্পজাতীয় এবং পাঙ্গাশ মাছের।