জানা গেছে, চীন থেকে এ কাঠামো তৈরির সরঞ্জামের আরেকটি চালান গত ১৫ আগস্ট মংলার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। পড়ে ওখান থেকে মাওয়ায় আসবে। এদিকে সেতুর দুই পিলারের মধ্যে গাড়ি চলাচলের স্থানকেই স্প্যান বলা হয়। মাওয়ার’ কুমারভোগ-সেতু ইয়ার্ডের সি(নাইন) থেকে বার্জে করে নদীর পারের ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে মেম্বার ও জয়েন্ট যোগ করে একেকটি স্প্যান তৈরির প্রস্তুতির কাজ চলছে। সেতুর স্প্যান তৈরির কাজ শুরুর পাশাপাশি সেতু এলাকা এখন ভারি ভারি নির্মাণ কাজের যন্ত্রে ছেয়ে এলাকা। চার দিকেই কাজ আর কাজ জাজিরা প্রান্তে মূল সেতুর পাইলিংয়ের কাজও এগোচ্ছে। জাজিরার ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলারে প্রথম ধাপের দুটি স্প্যান বসানো হবে। এদিকে পদ্মা নদীতে পাইল স্থাপনের পাশাপাশি তীরের ভায়াডাক্টের (সংযোগ সেতুর) মূল পাইলও স্থাপন চলছে। সেইসাথে গত ৮ আগস্ট মূল পাইল স্থাপন শুরু হয়েছে। জাজিরা প্রান্তের ২২ নম্বর পিলারের একটি পাইল স্থাপন শুরু হয়েছে। সেখানে একযোগে আরো তিনটি পাইল স্থাপনের কাজ চলছে এখন।
মাওয়ায় এক কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে চীন থেকে আনা মেম্বার, জয়েন্টসহ বিভিন্ন অংশ সংযুক্ত করার জন্য প্রস্ততি নেওয়া হয়েছে। মূল সেতু তৈরির জন্য মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত একের পর এক ৪১টি স্প্যান বসানো হবে।চায়না রেলওয়ে সানহাইগুয়ান ব্রিজ গ্রুপ কম্পানি লিমিটেডের (সিআরএসবিজি) অধীনে চীনের সিনহোয়াংদাওয়ের কারখানায় স্প্যানের বিভিন্ন অংশ তৈরি হচ্ছে। সিনহোয়ান বন্দর থেকে জাহাজে করে মংলা বন্দর হয়ে পরে বার্জে করে চাঁদপুর হয়ে মাওয়ায় আনা হচ্ছে সেগুলো। প্রথম চালানের প্রথম বার্জটি মাওয়ায় আসে গত ৮ আগস্ট। প্রথম চালান তিন হাজার ৮৯২ টন ওজনের ১৫২টি ইস্টিলের বলা হয় স্প্যান বিভক্ত। এগুলোর মধ্যে জয়েন্ট, সেকশন, ডয়াগনাল মেম্বার, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকড্রে মতো অংশগুলো আছে। চীনের রাজধানী পেইচিং থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে ওই কারখানায় নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকৌশলীদের। আগামী ডিসেম্বরে জোড়া দেওয়া শেষে স্প্যান তৈরির পর তা পদ্মা সেতুর পিলারের ওপর বসানো শুরু হবে।
বর্তমানে মাওয়ায় পদ্মাতীরের অদূরে ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে সেতুর উপরিভাগের (স্প্যান) জয়েন্টের কাজ চলছে। কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ু প্রবাহ ও ভূমিকম্পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেওয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। চীন এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা যৌথভাবে সেতুর জয়েন্ট, সেকশন, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকর্ড অংশের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এগুলোর বেশিরভাগ কাজই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হচ্ছে। মাওয়া পয়েন্টে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়কে থাকা ব্রিজ, সংযোগ সড়কের পাশের সার্ভিস রোড তৈরি।পদ্মাসেতুপ্রকল্পের (মূল সেতু) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আবদুল কাদের প্রতিবেদককে জানান, কাজের গতি আরও বাড়াতে চীন থেকে আনা হচ্ছে আরেকটি শক্তিশালী হ্যামার এবং ফ্লোটিং ক্রেন। এ মাসের শেষ দিকে মাওয়ায় এসে পৌঁছাবে আরেকটি স্প্যান।
তিনি আরো বলেন, এ পর্যন্ত যে স্প্যান গুলো চীন থেকে এসেছে। যেগুলো মাওয়া অংশে ওয়ার্কশপে জয়েন্ট দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটির কাজ শেষ হয়ে মাত্র। অন্যটির কাজ চলছে। সেতুর নকশা পরিকল্পনা অনুযায়ী, উপরের অংশের সোনালি রঙের দু’টি স্প্যানের মধ্যে ৩৪টি জয়েন্ট হবে। ওয়ার্কশপে এখন পর্যন্ত ৪টি জয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে। একেকটি জয়েন্টের ওজন ৪৮ থেকে ৬০ টন আর একটি সেতুর কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত সবচেয়ে ভাড়ি চার হাজার টন ক্ষমতার ক্রেন। পদ্মাসেতুর প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে মোট ২৪০টি পাইল থাকবে। আর দুই প্রান্তে আরও ১২টি করে ২৪টি পাইল থাকবে। দেওয়ান কাদের আরও জানান, যে দু’টি স্প্যানের কাজ চলছে সেগুলো মাওয়া অংশের ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের মাঝামাঝিতে আর আরেকটি স্প্যান ৩৭ ও ৩৮ এর মাঝামাঝি বসবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর মধ্যে কয়েকটি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে। নতুন আরও কয়েকটি পিলারের কাজ চলছে। নদীর দুই পাশে সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষের দিকে। তবে সংযোগ সেতুর কিছু কাজ উদ্বোধনের ঠিক আগে শেষ করা হবে, যাতে ফিনিশিং সুন্দর হয়। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে দেশের অন্য জেলাগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। ব্যবসা-ব্যানিজ্য প্রসার হবে। এসময় পদ্মায় স্রোত বাড়ার। সাথে বেড়েছে কাজের গতিও। এদিকে মাওয়া প্রান্তের উজানের স্রোতের কারণে নদী ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাই পদ্মাসেতু কৃর্তপক্ষ মাওয়া পুরনো ফেরিঘাট থেকে কান্দিপাড়া জামান ক্লাব পর্যন্ত ১৩শ’ মিটার এলাকায় নদী ভাঙ্গন রোধে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানের এই এলাকায় প্রায় ১ লাখ জিও ব্যাগ ফেলা সহ নানান ব্যবস্তা নেয়া হয়েছে,প্রাকৃতিক সখ্যম হয়েছে।বহরে এগিয়ে চলছে সেতুর কাজ। রোদ-কোয়াশা উপেক্ষা করেই রাতদিন চলছে কাজ।
এদিকে, মাওয়া থেকে জষলদিয়া, কান্দিপাড়া ও কবুতরখোলা পর্যন্ত এই নদী শাসন এখনি জরুরী।হয়ে পরেছে, নতোবা ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের এর আগে গতবছর এদিনেই জসলদিয়া বাজারের সামনে নদী ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। এতে জসলদিয়া গ্রামের মাঝি বাড়ির একাংশ বিলীন হয়েছে। হুমকীর মুখে রয়েছে জসলদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, ডাকঘর, কমিউনিটি ক্লিনিক, জসলিদিয়া পদ্মাসেতু পূনবাসন কেন্দ্র ও ওয়াসার জসলদিয়া পানি শোধনাগারসহ বাড়ি-ঘর ফসলী জমি এবং বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে ভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে হলেও নদী ভাঙ্গনরোধে দ্রূত কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে দায়িত্বশীলও এঅঞ্চলের বাসিন্দারা মনে করছেন। এদিকে পদ্মা সেতুর ঘিরে আশপাশের চিত্র যেন মন পাল্টে যাচ্ছে। চিত্র পাল্টাচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও। সেতু চালু হওয়ার আগেই এই অঞ্চলের এই পরিবর্তন আর পরে যে কি হতে তাই নিয়ে ভাবছেন অধিবাসীরা। পদ্মার এই কর্মযজ্ঞের প্রায় ১ কিলোমিটাার দূরের বাসিন্দা শেখ জামান তিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ট্যুরে ছিলেন বিশ্বের অনেক শহর সম্পর্কে তাঁর বেশ ধারণা রয়েছে। তিনি মনে করেন এই সেতু ঘিরে যে পরিবেশ এখানে তৈরি হচ্ছে সেটি বিশ্বের অন্যতম পর্যটন এলাকা হবে সহজেই। তবে প্রয়োজন পরিকল্পনা। সভ্যতার জনপদ হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের প্রাচীন স্থাপত্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন এই পদ্মা সেতু স্থাপনা এখানে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আঃ রশিদ শিকদার ও সাংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, পদ্মা তীরের জীববৈচিত্র্য এবং বিশাল চর ও আশপাশ নিয়ে অনেক পরিকল্পনাই রয়েছে। সবই দিনেদিনে পরিকল্পিত হবে। ও বাঙালী জাতির অনেক স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। এদিকে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে সেতু ও পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন যেন মাওয়ার বাসিন্দা। তিনি প্রায়শই এই নির্মাণযজ্ঞ পরিদর্শনে আসছেন অবস্থানও করছেন এখানে। এতে সেতুর কাজের গতি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পদ্মাসেতু কৃর্তপক্ষরা এদিকে এ সেতুর কাজ পর্যবেক্ষণে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষঞ্জ দল এসেছিল। এই বিশেষঞ্জ প্যানেল গত অক্টবরের শুরুতেই সেতুটির দুইদিন ধরে বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান থেকে বিশেষজ্ঞ টিমের অপর বিদেশী সদস্য কানাডার অস্টেন ফিল্ট ও নেদারল্যান্ড সর কারবাজাল পথে হয়ে। জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ বাংলাদেশের পাঁচ জন এবং বিদেশী ৪ জন। মোট ৯ জনের এ টিম বৈঠকে ছিলেন। ওয়েল্ডিং এর আলোর ঝলকানি আর ভারী যন্ত্রপাতির শব্দে কর্মমুখর পদ্মার পাড় পাশাপাশি অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ চলছে পুরোদুমে। এর আগে উপজেলার পদ্মা সেতুর প্রকল্পের সার্ভিস এরিয়ায় সভাকক্ষে সেতু মন্ত্রী সাংবাদিদের-বলেন ‘পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়। এটি এখন দৃশ্যমান বাস্তব। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।’ পদ্মা সেতুর অগ্রগতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন পদ্মা সেতুর নির্মান কাজ প্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে চলছে।