অগ্রসর রিপোর্ট :মানুষকে সুরক্ষা প্রদানে সম্ভব সবকিছুই সরকার করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে প্রযুক্তির ব্যবহার জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস করলেও জনগণকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আর একটা ঘুর্ণিঝড় কিন্তু আসছে। আমরা আধুনিক প্রযুক্তির কারণে অনেক আগে থেকেই জানতে পারি। আর এসব বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা আমরা ইতোমধ্যে নিতে শুরু করেছি। ইনশাল্লাহ আমরা সতর্ক থাকবো এবং ঝুঁকি হ্রাস করতে পারবো।’
তিনি বলেন, ‘সরকার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বান্তকরণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেননা, সম্পদ চলে গেলে সম্পদ পাওয়া যায়, কিন্তু‘ জীবন চলে গেলে আর পাওয়া যায় না। এজন্য জনসচেতনতা বেশি প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, টর্নেডো, বজ্রপাত, ভূমিধ্বস অথবা ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড সবকিছুতেই মানুষকে রক্ষা করা বা সুরক্ষিত রাখার জন্য যা যা করণীয় সে ব্যবস্থাগুলো আমরা করে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২২৫টি স্থাপনার উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মনে রাখতে হবে এটা ব-দ্বীপ। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশে মাঝে মাঝে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগও আসে। সব মোকাবেলা করেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এবং আমরা এগিয়ে যাব।’
মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে এদিন দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১১০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, ৩০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, ৩০টি জেলা ত্রাণ গুদাম-কাম-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র ও পাঁচটি মুজিব কিল্লার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি একইসাথে ৫০টি মুজিব কিল্লার ভিত্তিপ্রস্তর ও স্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ থেকে ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ উদ্ধৃত করেন এবং বলেন, ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, এটা আমরা বিশ^াস করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, সঠিক দিক নির্দেশনা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, আদর্শ নিয়ে চললে বাংলাদেশের মানুষকে কেউ কখনও দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সেভাবেই দেশকে গড়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে তিনি করেনাভাইরাস সম্পর্কে সকলকে পুণরায় সতর্ক করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান পূণর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘সকলে মিলে এই দুর্যোগকেও আমরা প্রতিহত সক্ষম হব, ইনশাল্লাহ।’
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের কাজ নিজে করা, বিশেষ করে যুবসমাজ যাতে নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে তার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর একটি ভিডিও চিত্র ও প্রদর্শিত হয়। গণভবন থেকে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী নোয়াখালীর সুবর্ণচর, বরিশালের উজিরপুর এবং গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর উপজেলার উপকারভোগীদের সঙ্গে পরে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্যোগ মোকবেলায় যে সক্ষমতা তা আজকে সারাবিশ্বে সমাদৃত। যে কারণে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘গ্লোবাল এডাপটেশন সেন্টারে’র কার্যালয় বাংলাদেশে স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, একটা ছোট্ট ভূখন্ডের মধ্যে প্রতি নিয়ত দুর্যোগ মোকাবেলা করেও আমরা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছি। সেকারণে আমরাদের ওপর দায়িত্ব পড়েছে সারাবিশ্বে কিভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করা যেতে পারে তার পরিকল্পনা নেওয়ার, বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং করার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নানা সময়ে নানাভাবে আসে সে বিষয়ে কাজ করার জন্যই এই গ্লোবাল এডাপটেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং সারাবিশ্ব এখন বাংলাদেশকে দুর্যোগ মোকাবেলায় একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখে। যেটা বাংলাদেশ এবং এর জনগণের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক।
দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে তাঁর সরকার নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা এবং অবকাঠামোর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যেই ২৩০টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, ৩২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া, ১৬টি জেলার ৮২টি উপজেলার ২২০টি ঘুর্নিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, ২৬৭টি উপজেলা ৪২৩টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান আছে। ৬৩টি জেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাম তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্যোগকালীন মানুষের কাছে খাদ্য সাহায্য দ্রুত যাতে পৌঁছানো যায় তারজন্য সরকার পরিকল্পনা করে এই উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি জেলায় সরকার ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ করে দিচ্ছে যাতে যেকোন দুর্যোগে দমকলকর্মীরা দ্রুত সেখানে পৌঁছে ব্যবস্থা নিতে পারে।
সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভলান্টিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন সবথেকে আশার কথা ভলান্টিয়ারদের অর্ধেকই নারী এবং এটাই সবথেকে আনন্দের কথা নারী-পুরুষ সকলে মিলেই আজকে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের হাতে হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেওয়া, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বিস্তৃত করা এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গতির সঞ্চার করেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের সকলে একযোগে কাজ করে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, কোস্ট গার্ড, আনসার ভিডিপি থেকে শুরু করে প্রশাসন এবং অন্যান্য সকলে এবং বিভিন্ন ভলান্টিয়ার অর্গানাইজেশনগুলো যারা দুর্যোগ সম্পর্কে নানা সচেতনতা সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে ত্রাণ তৎপরতা সকল কাজেই অংশ গ্রহণ করে।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগ দুর্বিপাকে মানুষের জন্যই মানুষ। মানুষের পাশেই মানুষ থাকবে- সেই চিন্তা থেকেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ইতোমধ্যেই আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুণর্বাসনে ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছি অগ্নিনির্বাপন, বা ভূমিকম্প বা ভূমিধ্বস হলে সেখান থেকে মানুষকে রক্ষা করা এবং তাদের উদ্ধার কাজ কিভাবে পরিচালনা করা যায় সে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এখানে আমাদের ফায়ার সার্ভিস এবং সশ¯্রবাহিনী বিভাগ মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যেই জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০২১ থেকে ২০২৫ প্রণীত হয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ একটা ব-দ্বীপ কাজেই এই ব-দ্বীপ অঞ্চলটাকে সুরক্ষিত করে আমাদের মানুষের জীবনযাত্রাটা যাতে সুরক্ষিত হয় এবং সেটা আজকের জন্য নয় আগামী প্রজন্মের জন্য শতবর্ষের একটা পরিকল্পনা অর্থাৎ ২১০০ সালের বাংলাদেশ কেমন হবে, কিভাবে নিরাপদ হবে, মানুষের জীবনযাত্রা কিভাবে উন্নত হবে সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করেছি।
তিনি ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নের উদ্দেশ সম্পর্কে বলেন, আমাদের নদী মাতৃক দেশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং একটা ব-দ্বীপ। এই ব-দ্বীপটাকে সুরক্ষিত করা এবং এখানকার মানুষেরা যাতে সুন্দরভাবে নিরাপদে বাঁচতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করবো। আল্লাহর রহমতে আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হয়েছি। অথচ সাড়ে ৩ বছরে জাতির পিতা বাংলাদেকে একটি স্বল্পোন্নত দেশে পরিণত করলেও এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা যেন ঘুমিয়েই কাটিয়েছে এবং নিজেদের সম্পদ বাড়াতেই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কিছুই করে নাই।
‘আওয়ামী লীগ মানুষের জন্য রাজনীতি করে,’ উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে কেবল মানুষের কল্যাণেই কাজ করেছে। আজকে ১২ বছরে ক্ষমতায় আমরা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি, যে প্রতিশ্রুতি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা করেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বিতরণ এবং আমরা ঘর তৈরী করে দিচ্ছি, যাতে একটি মানুষও আর গৃহহীন না থাকে, যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। একটি সেমি পাকা ঘর বা এখন দুর্যোগ মোকাবেলায় সহনশীল ঘর আমরা করে দিচ্ছি।