দেশের অন্যতম স্পর্শকাতর স্থাপনা জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনের যে কোনো একটিতে হামলার টার্গেট ছিল কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গিদের। এ দুটি ভবন কয়েক দফা রেকি (মহড়া) করে হামলার ছকও চূড়ান্ত করেছিল তারা। ওই পর্যায়ে আরও কয়েকজন সঙ্গী ও পর্যাপ্ত অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিল জঙ্গিরা।
ঠিক তখনই গোপন খবরের ভিত্তিতে রাজধানীর কল্যাণপুরে ৫ নম্বর সড়কে ৫৩ নম্বর বাড়িতে (তাজ মঞ্জিল) তাদের আস্তানায় ২৬ জুলাই অভিযান চালায় পুলিশ, যেটির নাম ছিল ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’। এতে নিহত হয় ৯ জঙ্গি সদস্য। আর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান রিগ্যান নামে এক জঙ্গি। এই হাসান জিজ্ঞাসাবাদে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ঘটনার পর ওই বাড়ি থেকে আলামত হিসেবে উদ্ধার করা দুটি পেন ড্রাইভে জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের ছবি ছাড়াও সেখানে কীভাবে হামলা পরিচালনা করা হবে তার একটি ‘লে-আউট’ পাওয়া গেছে।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদে একদিনে একই সময়ে হামলার টার্গেট ছিল জঙ্গিদের। এরই অংশ হিসেবে হামলার এই দুই স্থানের আশপাশে (বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও কল্যাণপুর) বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গিরা।
হামলার লক্ষ্য স্থির করে জঙ্গিরা হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শিয়া মসজিদ কয়েক দফা রেকিও করে। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদে হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে জঙ্গিরা। বিশেষ করে শিয়া মসজিদের সামনে সার্বক্ষণিক পুলিশি প্রহরা ও বিপুল জনসমাগমের কারণে জঙ্গিরা হামলার লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তন করে।
আর এ কারণে ১ জুলাই হলি আর্টিজানে হামলা চালালেও জঙ্গিদের দ্বিতীয় হামলার পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হয়। তবে শিয়া মসজিদে হামলার পরিকল্পনা স্থগিত করা হলেও পরবর্তীতে তারা হামলার টার্গেট হিসেবে বেছে নেয় স্পর্শকাতর স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন ও বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনকে।
এ দুটির যে কোনো একটিতে হামলার জন্য চূড়ান্ত ছক আঁকতে থাকে জঙ্গিরা। ওই কর্মকর্তা বলেন, অভিযানের পর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা দুটি পেন ড্রাইভের একটিতে মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ, জাতীয় সংসদ ভবন এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের ছবিসহ বিভিন্ন ‘লে-আউট’ পাওয়া গেছে। এছাড়া ওই পেন ড্রাইভে অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্সে নিহত জঙ্গিদের কালো পোশাক পরা ছবিও পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, চিকিৎসকদের অনুমতি নিয়ে তারা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাধীন রাকিবুল হাসানকে বেশ কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার তথ্যমতে স্পর্শকাতর স্থাপনায় হামলার জন্য পর্যাপ্ত সদস্য এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ ছিল না। এ কারণে তারা অধিক সংখ্যক সদস্য এবং অস্ত্র-গোলাবারুদের মজুদ গড়তে কল্যাণপুরের আস্তানায় জঙ্গিরা অপেক্ষা করতে থাকে।
জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে হামলার পর ওই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তার সহযোগীদের নাম ফাঁস হয়ে যায়।
বাংলাদেশে আইএসের প্রধান তামিম আহমেদ চৌধুরী তার ঘনিষ্ঠ চার সহযোগীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে তিনি ওই চার সহযোগীকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবস্থান করছেন বলে তথ্য রয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে।
পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গির মধ্যে তামিম চৌধুরী ছাড়া অন্য চারজন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ ওজাকি, লক্ষ্মীপুরের এটিএম তাজউদ্দিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারী ও কুমিল্লার জুন্নুন শিকদার। এসব জঙ্গি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে- এমন তথ্য পাওয়ার পরপরই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা ভারতকে অবহিত করা হয়।
মো. মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্সে নিহত নয় জঙ্গির মধ্যে রোববার পর্যন্ত আটজনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গোয়েন্দা পুলিশ ও স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড টেকটিক্স (সোয়াত) টিমের সমন্বয়ে ওই অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। পরে ঘটনাস্থল থেকে বাড়ির মালিকের স্ত্রী, ছেলে, ম্যানেজার, দারোয়ান ও ভাড়াটিয়াসহ ৪২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
তিনি জানান, অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ওই বাড়ি থেকে দুটি পেন ড্রাইভ, একটি ভাঙা সিম্ফনি মোবাইল সেট এবং ভাঙা ল্যাপটপসহ মোট ৫৪ ধরনের আলামত জব্দ করে। জব্দ করা ভাঙা মোবাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা অসংখ্য এসএমএস বার্তাও পেয়েছেন।
এছাড়া ভাঙা ল্যাপটপ থেকে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে জব্দ ইলেকট্রিক ডিভাইস থেকে পাওয়া গেছে আরও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিশেষ করে একটি ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫ জঙ্গির নাম ও ছবি।
তারা মাঝে-মধ্যে কল্যাণপুরের ওই বাসায় যাতায়াত করত বলে ভবনের বাসিন্দারা জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। গোয়েন্দারা এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব জঙ্গিকে গ্রেফতারে প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করছে।
সূত্র: যুগান্তর।