নিজস্ব সংবাদদাতা- দ্বিতীয় ইউনিটের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করে এনেছে আশুলিয়ার হাই ফ্যাশন লন্ড্রি লিমিটেড। বাকি শুধু মূলধনি যন্ত্রপাতি স্থাপন। কিন্তু গ্যাসের অনিশ্চয়তায় যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারছে না বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানটি। যদিও প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে সম্প্রসারিত ইউনিটটিতে। বস্ত্র খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ। গাজীপুরের টঙ্গীতে সম্প্রসারিত ইউনিটে মূলধনি যন্ত্রপাতি স্থাপন শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকায় চালু করা সম্ভব হচ্ছে না কারখানাটি।
হাই ফ্যাশন ও নোমান গ্রুপের মতো একই অবস্থা বস্ত্র ও পোশাক খাতের আড়াই শতাধিক কারখানার। সব প্রস্তুতি শেষ করেও শুধু গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না এগুলো। এসব কারখানার সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না, পোশাক খাতে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩৩টি। এসব প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের প্রয়োজন প্রায় ১৪ কোটি ২৭ লাখ ঘনফুট। পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে রফতানি আয় আসবে বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। আর কর্মসংস্থান হবে প্রায় সাত লাখ মানুষের। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। বস্ত্র খাতের সংগঠন বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না এ খাতের ২৭টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্পিনিং মিলগুলোর স্পিন্ডল সামর্থ্য সাত লাখ। এতে কর্মসংস্থান হবে প্রায় দেড় লাখ মানুষের। আর বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
শিল্পে গ্যাস সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, শিল্পে গ্যাস দেয়ার সদিচ্ছা সরকারের রয়েছে। কোথাও কোথাও দেয়াও হচ্ছে। তবে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায় সরকার। তাই সচেতন অবস্থান থেকে উচ্চপর্যায়ের কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। চূড়ান্ত না হলেও গ্যাস দেয়ার ক্ষেত্রে কো-জেনারেশন, বিকল্প জ্বালানির মতো শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংযোগ পেতে উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি এ তৎপরতা বেড়েছে। গত মাসেই জ্বালানি উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা আলোচনা করেছেন। সর্বশেষ গত রোববার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। সরকার গ্যাস সংযোগের আশ্বাস দিলেও বিনিয়োগ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় কাটছে না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। কিন্তু সংযোগ পেয়ে উৎপাদন শুরু করতে পারলেই উদ্যোক্তারা স্বস্তিবোধ করতে পারবেন। এর আগ পর্যন্ত দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। কারণ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ চক্রহারে বাড়ছে।’ বিজিএমইএ সূত্র অনুযায়ী, গ্যাস নিয়ে তিন ধরনের সমস্যায় রয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকরা। এ খাতের ২৩৩টির মধ্যে গ্যাস সংযোগ জটিলতায় রয়েছে ৬৪টি কারখানা। ঢাকা থেকে নতুন স্থানে কারখানা স্থানান্তর করতে পারলেও নতুন স্থানে গ্যাস সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া গ্যাসের লোড বৃদ্ধির আবেদন রয়েছে ৮৬টি কারখানার। বৃদ্ধি করা লোডের মাধ্যমে কারখানাগুলোর গ্যাসের চাহিদা তিন কোটি ঘনফুট। আবার নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন রয়েছে, এমন কারখানা আছে ৮৩টি। সব মিলিয়ে কারখানাগুলোর গ্যাসের চাহিদা ১৪ কোটি ২৭ লাখ ঘনফুট।
প্রসঙ্গত. দেশে উৎপাদিত মোট গ্যাসের ৪২ শতাংশ ব্যবহার হয় বিদ্যুেকন্দ্রে। এর বাইরে ১৬ শতাংশ ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এছাড়া শিল্পে ১৭, আবাসিকে ১১, সার কারখানায় ৭ ও সিএনজিতে ব্যবহার হয় ৬ শতাংশ গ্যাস। শিল্পে ৪১৭ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ আছে ৪০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় বস্ত্র ও পোশাক খাতে গ্যাস বরাদ্দ বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, দেশে সারের যে চাহিদা, সরকার চাইলে তা আমদানি করতে পারে। আর সারের ৭ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ যদি বস্ত্র ও পোশাক খাতে দেয়া হয়, তাহলে থমকে যাওয়া বিনিয়োগ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘পোশাক খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ লক্ষ্য পূরণে এ খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। যদিও এরই মধ্যে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছেন না। সরকার চাইলে বর্তমানে বরাদ্দ রয়েছে, এমন অন্য খাতের গ্যাস পোশাক খাতে দিতে পারে।’
শিল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকার গত বছর গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি ২০১৪ তৈরি করেছে। নতুন নিয়মাবলির উল্লিখিত ধারাগুলোই গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করেছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প স্থানান্তর প্রক্রিয়া। নিয়মাবলি পরিবর্তনের মাধ্যমেও থমকে থাকা বিনিয়োগ নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান করা যেতে পারে। বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘গ্যাসের আশায় থেকে উদ্যোক্তাদের সামনে মরণ ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। কারণ ব্যাংকঋণ ও তার উচ্চসুদে নতুন বিনিয়োগ একসময় রুগ্ণ হয়ে পড়বে। আবার এর মধ্যে যারা অত্যাধুনিক মেশিনারি স্থাপন করেছে, সেগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, বিনিয়োগ বোর্ডের নিবন্ধনসহ সব প্রক্রিয়া ঠিক রেখে যারা প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগ করেছে, মেশিন স্থাপন করেও যারা উৎপাদনে যেতে পারছে না, এমন কারখানাগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস দেয়া হোক।’
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ হিসাবে প্রতিদিন গ্যাসের ঘাটতি ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট।