অগ্রসর রিপোর্ট: অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় একটি যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি-মুক্তি বিষয়ক চুক্তির জন্য চাপ দিতে ইসরায়েলে পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ব্লিঙ্কেনের এটি নবম ইসরায়েল সফর।
সোমবার ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগের সঙ্গে বৈঠকে ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন, চলমান আলোচনা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভবত শেষ সুযোগ।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত- জিম্মিদের মুক্তি, যুদ্ধবিরতি এবং স্থায়ী শান্তি ও সকলের নিরাপত্তার জন্য একটি চুক্তিতে যাওয়ার সম্ভবত এটি সেরা এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ।’
গত সপ্তাহে কাতারের রাজধানী দোহায় গাজাযুদ্ধ নিয়ে দু-পক্ষের মধ্যে আবারও আলোচনা শুরু হয়। তবে কোন ফলাফল ছাড়াই আলোচনা স্থগিত করা হয়।
ব্লিঙ্কেনের এই সফরের কিছুদিন আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার বৈরিতা ও ব্যবধান দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ীভাবে দূর করার লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা পরিবর্তিত নমনীয় এক প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। মূলত তারপর থেকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছে। যদিও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে হামাস।
হামাস জোর দিয়ে বলেছে, গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে কি-না, সেটি নিয়ে এখনও চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সব মিলিয়ে যুদ্ধবিরতির যে চুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেটি একটি ‘ভ্রম’ বলে মন্তব্য করেছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সোমবার ব্লিঙ্কেন ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরায়েলের ওপর আবারও চাপ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। সেদিক থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই হয়ত যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কার্যকর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যদিও ইসরায়েল ও হামাস, কোনো পক্ষই তেমন কিছুরই আভাস দেয়নি। উল্টো, যুদ্ধবিরতি না হওয়ার কারণ হিসেবে এখনও তারা একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে।
অন্যদিকে রবিবার এক বিবৃতিতে হামাস অভিযোগ করেছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে নতুন নতুন শর্ত ও দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন। কাজেই যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যস্থতাকারী যেসব পক্ষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটি নস্যাৎ করার জন্য জন্য ইসরায়েলই সম্পূর্ণরূপে দায়ী বলে মন্তব্য করেছে হামাস।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চলতি সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি’।
যদিও গত কয়েক মাস ধরেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নানান আলোচনা শোনা গেছে। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে আশার আলো দেখা গেছে বলা হলেও পরবর্তীতে তেমন কিছুই ঘটতে দেখা যায়নি।
গত মে মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
সেখানে বলা হয়েছে যে, মোট তিন ধাপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে, যার প্রথম ধাপ শুরু হবে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে। ওই সময়ে গাজার জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের সরিয়ে নেয়া হবে। দেওয়া হবে মানবিক সহায়তা। একই সঙ্গে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যে বন্দী এবং জিম্মি বিনিময় হবে বলেও প্রস্তাবে বলা হয়।
যুদ্ধবিরতির ওই প্রস্তাবে ইসরায়েল রাজি হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদ ব্যক্ত করছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার কয়েক জন সদস্য প্রস্তাবটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রবিবার নিজ দেশের মন্ত্রিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, হামাসের হাতে জিম্মি নাগরিকদের মুক্ত করার জন্য আলোচনা চলছে। তবে ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়ে তারা কোনো ছাড় দিবেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নেতানিয়াহু বলেন, ‘এমন কিছু বিষয় আছে, যেসব ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং আমরা নমনীয় হতে পারি না। আমরা ওইসব বিষয়গুলোর ওপর জোর দিয়ে যাবো। আমরা খুব ভালভাবেই জানি যে, কীভাবে দু’টির মধ্যে পার্থক্য করতে হয়।’
তখন জিম্মিদের মধ্যে একশ পাঁচ জনকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। এর বিপরীতে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী ২৪০ ফিলিস্তিনিকে মুক্ত দিয়েছিল ইসরায়েল।
তখন ইসরায়েল জানিয়েছিল যে, তাদের শতাধিক নাগরিক এখনও হামাসের হাতে জিম্মি রয়েছে। ওইসব জিন্মিদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন ইতোমধ্যেই মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এদিন ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। পাশাপাশি ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
তারপর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। পরে ২৮ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও। ১০ মাসের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন ৯২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
গত বছরের নভেম্বরে কাতারের মধ্যস্থতায় প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরায়েল। এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ২৪০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ৭১ জন মহিলা এবং ১৬৯টি শিশু রয়েছে। বিনিময়ে ২৪ বিদেশিসহ মোট ১০৫ জনকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। হামাসের কাছে এখনো প্রায় ১২০ জন জিম্মি রয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের।
সূত্র: বিবিসি, টাইমস অব ইসরায়েল