কক্সবাজার প্রতিনিধি : বৈশাখের পুরো মাস সময় পর্যন্ত আবহাওয়া সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে মাঝারি থেকে তীব্র তাপদাহে তেঁতে উঠেছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারের মানুষ। জেলায় এখন বিরাজ করছে কাঠফাটা রোদ। সকাল থেকে সূর্যের বিচ্ছুরণ দুপুরের মধ্যে বাতাস যেন আগুনে পরিণত হচ্ছে। কোথাও কোন স্বস্তির সেই বাতাশ ও আরাম পাচ্ছেনা কোন মানুষ।
চারিদিকে রোদ আর রোদ। অপরদিকে স্বরনকালের ভয়াবহ লোডশেডিংও গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষকে কষ্টের বুঝা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার জেলার সর্বোচ্ছ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকদিন মৃদু তাপপ্রবাহ চললেও গত বৃহস্পতিবার থেকে তা মাঝারি তাপপ্রবাহে রূপ নিয়েছে।
গত রবিবার মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একদিন আগে শনিবার জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল অপরিবর্তিত ৩৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক জানান, রবিবার থেকে কক্সবাজার জেলায় মাঝারি তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। বর্তমানে আকাশে মেঘ না জমলে কক্সবাজারে আরও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এদিকে খরতাপে পুড়ছে কক্সবাজারসহ গোটা জেলার মানুষ। এতে খেটে খাওয়া মানুষসহ প্রাণিকূলের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। দুপুরের দিকে সূর্যের তীব্র তাপে চোখ-মুখ-ত্বক পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে উঠছে। একটু ঠান্ডার পরশ পাওয়ার আশায় মানুষ গাছতলায় আশ্রয় নিচ্ছে। ডাব, শরবত, আইসক্রিম, রসালো ফলের দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। ভ্যাপসা গরমে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়া এলাকার রিকশাচালক কবির আহমদ জানান, টানা কয়েক ঘণ্টা রিকশা চালানো যাচ্ছে না। রোদের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এত গরমেও পেটের দায়ে রিক্সা চালিয়ে টাকা উপার্জন করতে হচ্ছে। শহরে আনিছ নামে টমটমের এক চালক জানান, গরমের কারনে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেনা তাতে করে তারা রীতিমত ভাড়া ও যাত্রী পাচ্ছেনা। তারপরেও তীব্র গরমকে সহ্য করে অন্তত খরচের টাকার জন্য হলেও গাড়ী চালাতে হচ্ছে।
এদিকে ভ্যাপসা গরমের কারনে জেলায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যার ফলে রোগীর স্থান সংকুলান হচ্ছে না জেলা সদর হাসপাতালে। আবহাওয়া পরিবর্তন ও গরমের কারণে কক্সবাজারে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বারান্দায় বসে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, জেলায় দিনে ও রাতে অধিক গরমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ও বিভিন্ন খাবারের কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ সব বয়সী লোকজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এ ছাড়াও প্রতিদিন আউটডোরে ২০-২৫ জন ডায়রিয়া রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে জায়গা না থাকায় বারান্দায় বসে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। রোগীদের চিকিৎসা দিতে ডাক্তারদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. শাহিন আবদুর রহমান চৌধুরী জানান, অধিক গরমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ও বিভিন্ন খাবারের কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধসহ শিশুরা। বর্তমানে হাসপাতালে তাদের পর্যাপ্ত পরিমান চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে জেলায় অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করে এবছর সর্বোচ্ছ লোডশেডিং হচ্ছে বলে অধিকাংশ মানুষ অভিযোগ করেছেন। জেলা শহরের চেয়ে উপজেলাগুলোতে রাত-দিন ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকছেনা। সম্প্রতি টেকনাফ ও চকরিয়ায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবীতে মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষার কর্মসূচী পালন করা হয়েছে। আর ভয়াবহ লোডশেডিং এর কারন এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারপরেও সংশ্লিষ্টদের কোন ধরনের কর্নপাত হচ্ছেনা।
সাধারণ মানুষ অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে একদিকে প্রচন্ড গরম অন্যদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্থ জেলার জনজীবন। জেলাব্যাপী লোডশেডিং এর মাত্রা এত বেশি যে মানুষ বলছে বিদ্যুৎ থাকে না মাঝে মধ্যে আসে। চলতি মাসের শুরু থেকে লোডশেডিং চলে আসলেও সপ্তাহ খানেক ধরে এটি তীব্র আকার ধারন করেছে। এতে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। পিডিবির আওতাধীন এলাকায় দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না আর পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অবস্থা খুবই করুণ। ২৪ ঘন্টায় ঠিকমত ২ ঘন্টাও বিদ্যুৎ মিলছে না তাদের। এতে রাতেও ঠিকমত ঘুমাতে পারছে না গ্রামের মানুষ। টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা রংগীখালীর রিদুয়ানুল ইসলাম রিমন বলেন, একদিকে তীব্র গরম অন্যদিকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক। বাড়িতে আইপিএস থাকলেও বিদ্যুৎ না থাকায় সেটাও বন্ধ হয়ে পড়েছে। তাই রাতেও ঘুমাতে পারি না।
গতকাল রাতের প্রায় ৩ পর্যন্ত বাইরে চেয়ার নিয়ে বসেছিলাম। ঘরের ভেতরে গরমের কারণে ঘুমাতে পারছি না। রাস্তাঘাটে যেখানেই যায় সবার মুখে একই কথা বিদ্যুৎ নাই বিদ্যুৎ নাই। মানুষ এখন বলে বিদ্যুৎ নাকি মাঝে মাঝে আসে। মোট কথা খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। এরকম মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, রামু, উখিয়াসহ সব জায়গা থেকে একাধিক জনপ্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা সবাই দাবী করেন, বর্তমানে লোডশেডিং এর মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। তাদের দাবী সরকার বলছে এক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তাহলে সেটা যাচ্ছে কোথায়? এসময় অনেকে অভিযোগ করেন কর্তৃপক্ষ বিশেষ সুবিধা নিয়ে কিছু বিশেষ এলাকায় বেশি সরবরাহ দিচ্ছে।
এব্যাপারে কক্সবাজার পাওয়ার গ্রীড কোম্পানীতে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার পিডিবি এবং পল্লী বিদ্যুৎ মিলিয়ে বিদ্যুৎ এর চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ ৮০ মেগাওয়াট। সেখানে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ মেগাওয়াট পাওয়া যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার নূর মোঃ আজম মজুমদার বলেন, আমাদের দৈনিক চাহিদা থাকে ৫০ মেঘাওয়াটের বেশি। সেখানে আমরা পায় ২৫ থেকে ৩০ এর মত। তাই লোডশেডিং একটু বেড়েছে। তবে ৩ দিন ধরে কিছু বিদ্যুৎ লাইন উন্নতির জন্য সংস্কার কাজ চলছে।
জেলাবাসির জোরালো দাবী তীব্র এই গরমের সাথে বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি বন্ধ করে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রদানের আহবান জানান। অন্যথায় জেলার সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নামবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারন করেন।