অগ্রসর রিপোর্ট :বেড়েই চলছে করোনা সংক্রমণ। গত দুদিনে ১০ হাজারেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ যাবৎকালের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় সব ক্ষেত্রে সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার।
মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কায় নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাবে সেদিকে কঠোর নজর রাখছে সরকারের নীতিনির্ধারকরা। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতিও শুরু করেছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পোষাতে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যয় করতে হচ্ছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ করোনার আর্থিক ক্ষতির চেয়ে গত অর্থবছরে বেশি পরিমাণ দেয়া হয় প্রণোদনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ওয়েভে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আগামী চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে নতুন বাজেটে বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা বেশ ভালোভাবে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যখন বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ঠিক সেই সময় বিশ্বব্যাপী আবার করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। করোনার সংক্রমণ কমাতে ফ্রান্স, পোল্যান্ড এবং ইতালি আবার লকডাউনে চলে গেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে করোনা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের নতুন প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে আবার নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। প্রস্তুতি হিসেবে আগামী বাজেট সামনে রেখে নতুন কর্মসূচি নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি তিনি বলেন, করোনাভাইরাস রোধে টিকা কিনতে যত টাকা লাগবে সেই পরিমাণ বরাদ্দ দিতে প্রস্তুত রয়েছে সরকার। টাকার কোনো সমস্যা নেই। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ ছাড়া পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন প্রণোদনা প্যাকেজও আসতে পারে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা শুরু হয় গত বছরের মার্চ মাস থেকে। দেয়া হয় লকডাউন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বড় শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটিয়েছেন। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের উৎপাদন খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ও ওষুধসহ হাতে গোনা কয়েকটি খাতের উৎপাদন বাড়লেও বাকিগুলোতে ব্যাপক ধস নামে।
বেশিভাগ কলকারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথবা বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেয়। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য এবং অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। বড় খাতের পাশাপাশি মহামারিতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল কুটির, ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, মাঝারি বা সিএসএমই শিল্প খাত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০-এ এসএমই খাতে সামগ্রিকভাবে আয় কমেছে প্রায় ৬৬ শতাংশ এবং প্রায় ৭৬ শতাংশ উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত ছিল। বড়, মাঝারি ও ছোট খাতগুলোর বিপর্যয়ের ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে সারা বিশ্বে চাকরি হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। সব মিলিয়ে করোনায় অর্থনীতিতে মোট কত ক্ষতি হয়েছে, তা বের করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ‘সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। এতে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
এতে প্রাণহানিসহ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। তবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ১২ বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের কারণে অর্থনীতি স্বল্পসময়ে কোভিডপূর্ব অবস্থায় ফিরে এসেছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী চারটি নীতি-কৌশল এবং পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর পরিমাণ এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। এটি ১৪.৬ বিলিয়ন ডলারের সমান এবং জিডিপির ৪.৪৪ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রীর ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ৯টি প্যাকেজ সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত। এর মধ্যে গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহনির্মাণ অন্যতম একটি কর্মসূচি। এটি সামাজিক সুরক্ষা ও দারিদ্র্যবিমোচনে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। এই কার্যক্রমটি গৃহহীন ও ভূমিহীন অতিদরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনবে। অবহেলিত, বিশেষ করে নারীদের সামাজিক ক্ষমতায়ন করবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে করোনাপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। কোভিড মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কী করা হয়েছে তার একটি বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘কোভিড-১৯ জনিত অভিঘাত মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ৪টি নীতি-কৌশল অবলম্বন করেন। পরবর্তীতে এরই আলোকে পর্যায়ক্রমে ২৩টি অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সামাজিক সুরক্ষা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ‘বিগত ১২ বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায়, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি স্বল্পসময়ে কোভিড-পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে।’
জানা গেছে, গত বছরের মার্চ মাস থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে কত টাকা ঋণ পেয়েছে এবং কত টাকা ঋণ পাবে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে ১৫৬ কোটি ডলার ঋণচুক্তি সই করেছে সরকার।
বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর আওতায় করোনার টিকা আমদানি, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন এবং বাজেট ঘাটতি মেটানো হবে।
চলতি বাজেটে বিদেশি সহায়তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা যা, গত অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। এই অর্থ সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে বিশ্ব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফের সহায়তার ওপর।
এ প্রসঙ্গে অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি বলেন, করোনা মোকাবিলায় ও বাজেট সহায়তার জন্য দাতাদের কাছে ঋণ চাওয়া হচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজ সংক্রান্ত বৈঠকে এবার তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কোভিড মোকাবিলার বিষয়টি তারা ভালোভাবে অবগত আছেন। দাতা সংস্থাগুলো ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছে।