অগ্রসর রিপোর্ট: ব্যাংকের শাখায় শাখায় ডলার লেনদেনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তার আগে থেকে বিলাসপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের মতো নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসবের সুফল মিলতে শুরু করেছে। রবিবার ডলারপ্রতি ৮ টাকা কমে ১১২ টাকায় নেমে আসে এ বৈদেশিক মুদ্রাটির দাম।
বর্তমানে চলা মানি এক্সচেঞ্জগুলোর ওপর ডলারের নির্ভরশীলতা কমানের জন্যই মূলত ব্যাংকের শাখায় ডলার বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বর্তমানে এক হাজার ২০০ অনুমোদিত ডিলার বা এডি শাখা ও ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর শাখার মাধ্যমে সারা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অনুমোদন দেওয়া হবে।
তবে, ব্যাংকগুলো তাদের কোন কোন শাখার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করবে, তার তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠাবে। এসব শাখার একটি উপবিভাগ থেকে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হবে।
রবিবার খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম ১১২ থেকে ১১৪ টাকায় নেমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হয়েছিল ১১৮ থেকে ১২০ টাকা। অর্থাৎ এক কার্যদিবসের ব্যবধানে খোলা বাজারে ডলারের দাম কমেছে ৬ থেকে ৮ টাকা।
রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, দিলকুশা, আরামবাগের একাধিক খুচরা ডলার বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডলারের বাজার কমতির দিকে। সকালে শুরুতে ১১৫ টাকা বিক্রি করলেও বিকালের দিকে ১১২ টাকায় নেমে আসে ডলারের দাম।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঊর্ধ্বমুখী ডলার নিয়ন্ত্রণে আনতে বিলাসী পণ্যসহ সার্বিক আমদানিতে নানা শর্ত আরোপ করে। এরপর কমেছে আমদানির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার পরিমাণ। ডলারের দাম কমায় এরও প্রভাব আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মানি এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তা জানান, ‘ডলারের রেট অনেক পড়ে গেছে। কেউ বিক্রি করতে এলে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা ধরে কিনছি। আর ১১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৩ টাকায় বিক্রি করছি।’
বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন হঠাৎ হঠাৎ অভিযান চালাচ্ছে জানিয়ে ওই এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, খুচরা ডলার বিক্রেতারা এখন সরাসরি আগের মতো ডলার বিক্রি করছে না। তবে ডলারের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, যার করণে ডলারের দাম কমছে। তবে আগামীকাল দাম বাড়বে নাকি কমবে তা অনিশ্চিত।’
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়ায় বড় অংকের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। দেখা দিয়েছে ডলারের তীব্র সংকট। কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এমন পরিস্থিতিতে আমদানির লাগাম টানতে নানা শর্ত আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলার সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা জুলাই মাসের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। জুলাই মাসে আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে দেশে মোট ৫৫৫ কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা জুন মাসের তুলনায় ৩০ দশমিক ২০ শতাংশ কম। জুন মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের। জুন মাসে মে মাসের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র ৭ শতাংশ বেশি খোলা হয়েছিল। মে মাসে ঋণপত্র খোলা হয় ৭৪৪ কোটি ডলারের।
এপ্রিল মাস থেকে আমদানি কমতে শুরু করে। এপ্রিল মাসে মার্চের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। মে মাসেও এপ্রিলের তুলনায় আমদানি ঋণপত্র খোলা কমে সাড়ে ১৩ শতাংশ।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ঠিক রাখতে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে গত বছর আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ নেমে আসে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
গত শুক্রবার পর্যন্ত (১২ আগস্ট) রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি (৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন) ডলারে। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ বৈদেশিক মুদ্রা সজুত দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে রাশ টানার উদ্যোগ শুরু হয় গত মে মাস থেকে। তবে ৪ জুলাই এ ক্ষেত্রে বেশ কঠোরতা আরোপ করা হয়। গাড়ি, স্বর্ণ, টিভি, ফ্রিজসহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে শতভাগ। আর জ্বালানি, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, শিল্পে ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ কিছু পণ্য বাদে অন্য সব ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনের ন্যূনতম হার হবে ৭৫ শতাংশ। উভয় ক্ষেত্রে মার্জিনের জন্য ঋণ দেওয়া যাবে না। এর মানে এলসি খোলার সময়ই আমদানিকারকের নিজস্ব উৎস থেকে পুরো অর্থ নগদ দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানি কমলে ও রেমিট্যান্স বাড়লে ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া অন্যসব পণ্যের আমদানির এলসিতে শতভাগ মার্জিনসহ নানা শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে।
এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানি বিল মেটাতে এই দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। নিয়ম অনুযায়ী এটাই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর। চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এ দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। এ হিসাবে দেড় মাসের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ৮ টাকা ৫৫ পয়সা।
এদিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার প্রমাণ পাওয়ায় গত ৮ আগস্ট দেশি-বিদেশি ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো-বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।
চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনে ৮১ কোটি ৩০ লাখ (৮১৩ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৬ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৭ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ২৪৩ কোটি ডলার পর্যন্ত হতে পারে।