অগ্রসর রিপোর্ট :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকেই তাঁর মূল শক্তি এবং অনুপ্রেরণার উৎস্য উল্লেখ করে নিরাপত্তার নামে তাঁকে যেন জনবিচ্ছিন্ন করা না হয় সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকার জন্য এসএসএফ সদস্যদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এসএসএফ-এর সদস্যরা যারা আমাদের নিরপত্তায় নিয়োজিত তাদের এটুকুই বলবো- আমাদের মানুষ নিয়েই কাজ। সেই মানুষ থেকে যেন আমরা বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাই সেই দিকটায় একটু ভালভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শনিবার স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-এর ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দরবারে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি জনগণকে সাথে নিয়ে আর আমাদের যদি জনগণ থেকে আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে ঐ যে বলে না জলের মাছকে যদি ডাঙ্গায় তুলে ফেলে দেয়া হয় তাহলে কিন্তু তারা দাবরিয়ে দাবরিয়ে মরে যায়। আমাদের অবস্থাও কিন্তু সেরকম হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ এ বাবা-মা-ভাইদের হারিয়ে যখন একেবারে নিঃশ্ব হয়ে পড়ি তখন এই জনগণের ভালবাসাই আমাকে শক্তি যোগায় নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দেয়। এটা সব সময় কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।’
এসএসএফ-এর মহাপরিচালক মো. শফিকুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তবৃন্দ, বিভিন্ন দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট সিকিউরিটি ফোর্স নামে ১৯৮৬ সালে বর্তমানের এসএসএফ গঠিত হয়। সরকার প্রধান, রাষ্ট্র প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবরর্গের নিরাপত্তা বিধানই এই বাহিনীর দায়িত্ব। পরে এই বাহিনীর নাম হয় এসএসএফ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মানুষের জন্যই কিন্তুু কাজ করি। আমার ওপর যখন গ্রেনেড হামলা হয়েছে আমার সাথে থাকা মানুষগুলি সেই মানব ঢাল রচনা করেই কিন্তুু আমাকে রক্ষা করেছে। তবে, আমি সব সময় এটাই বিশ্বাস করেছি আল্লাহ মানুষকে সবসময় কিছু কাজ দেন সেই কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বোধ হয় আল্লাহই রক্ষা করে যান। নইলে একবারে মুখোমুখি আমি দেখেছি-গুলি চলছে। এক বার দুবার নয়, বারবার। আমার গাড়ির ওপর বোমা মারা হয়েছে। আর গ্রেনেড হামলাতো প্রকাশ্য দিবালোকে হয়েছে, সবাই দেখেছে। ট্রেনে গেছি সেখানে হামলা এবং গুলি এমন কি পাথর পর্যন্ত ছুঁড়ে মারা হয়েছে। এভাবে বহুবার বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়েই এগিয়ে যেতে হয়েছে। আল্লাহ যেভাবেই হোক প্রতিবার আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার নিজের জন্য যতটা না চিন্তা হয় এজন্য আমার নিরাপত্তার জন্য যারা থাকেন তাদের জন্য সব থেকে বেশি চিন্তা হয়। যে কারণে আমি প্রতিদিন প্রতিবার নামাজ পড়ে যখন দোয়া করি- আমার ছেলে-মেয়ে-সন্তানের জন্য যেমন দোয়া করি, দেশবাসীর জন্য দোয়া করি, সেই সাথে সাথে আমার জন্য যারা নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন তাদের জন্যও আমি সবথেকে বেশি দোয়া করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এটুকুই চাই এই ক্ষমতাটা আমার ভোগের নয়, ক্ষমতাটা হলো দেশের কাজের। আমি যেন সঠিকভাবে সঠিক চিন্তা করে দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে পারি। খোদা যেন আমাকে সেই শক্তি দেন। আর আমার সাথে যারা কর্মরত শুধু আমার নিরাপত্তার জন্য নয়, আমার সাথে যারা কাজ করেন সকলকেই যেন আল্লাহ হেফাজত করেন সকলকেই যেন নিরাপদ রাখেন এবং সকলকেই যেন সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ দেন এবং সকলের আশা-আকাঙ্খাই যেন পূরণ হয় এই দোয়া আমি প্রতিদিন সকলের জন্যই করে থাকি।
তিনি বলেন, আমি অনেক সময় অনেক কিছু মেনে চলি কারণ যখন চিন্তা করি আমি হয়তো বেঁচে যাব-আমাকে আল্লাহ যেটুকু কাজ দিয়েছেন সেটুকু হয়তো করবো কিন্তুু সাথে যারা থাকে (নিরাপত্তায়) তারা যেন বিপদে না পড়ে। নইলে আমি সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরেছি। আর বিরোধী দলে থাকতে আমাকে এতটা নিরাপত্তা কে দেবে। যেটুকু নিরাপত্তা ছিল তা যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারাতো কেড়ে নেয়। কাজেই আমি আমার পার্টির মানুষ, গ্রামের লোকজন তাদেরকে নিয়ে চলেছি। গ্রামের সাধারণ মানুষের অবস্থা আমার জানা আছে। বার বার যখন আঘাত এসেছে দেখেছি, কিছু না কিছু মানুষের জীবন চলে গেছে। কাজেই সেজন্যই সবসময় এটা মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করি তখন সংবিধানকে অনুসরণ করেই আমরা সরকার পরিচালনা করি। যার শুভ ফলটা দেশের মানুষ ও জনগণ পাচ্ছে।
তিনি বলেন, কারণ আমরা ওয়াদাবদ্ধ জনগণের কাছে, আমাদের দায়িত্ব রয়েছে- এদেশের মানুষের কাছে, আমাদের রাজনীতিটাই এদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করা, উন্নত জীবন দেয়া।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের অধিকারের কথা বলেই জীবনের অনেকটা সময় জেলে কাটিয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্র জীবন থেকেই তিনি এদেশের মানুষের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে সংগঠন করে মুষ্ঠিবদ্ধ চাল ভিক্ষা করেও এ দেশের মানুষের অন্ন যোগের চেষ্টা করেছেন। নিজের গোলার ধান, পরনের কাপড়, বই-খাতা তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপি’র আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ’নির্বাচন ঠেকানোর নামে যে জঘণ্য কাজ বিএনপি-জামায়াত করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একজন জীবন্ত মানুষকে কিভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা যেতে পারে। ’
তিনি বলেন, ‘যে মানুষের জন্য আমরা কাজ করি সেই মানুষ পুড়িয়ে মারাই নাকি তাদের আন্দোলন। এরকম আন্দোলন আমি জীবনে কখনও দেখিনি। তবে জনগণই এটা প্রতিরোধ করেছে। আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থা থেকে শুরু করে প্রত্যেকে সংস্থা কাজ করেছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেটা প্রতিহত করেছে। প্রায় ৫শ’র ওপর মানুষ মুত্যুবরণ করে, ২৬ জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যকে তারা হত্যা করে। হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়েছে। আহত বহু মানুষ এখনও মৃত্যুবরণ করছে। প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের মত গাড়ি, রেল ও রেল লাইন তারা ধ্বংস করেছে। হাজার হাজার গাছ কেটেছে। লঞ্চ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি মালিক এবং পরিবারকে আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এ ধরনের ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। যেটা সবাই রেখছেন। আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি এবং করে যাচ্ছি। কাজেই আমরা চাই না এ ধরনের ঘটনা আর ঘটুক। ভোটের মালিক জনগণ তারা ভোট দেবে তাদের ইচ্ছেমত। যাকে তারা চাইবে তাকেই তারা পাবে (ক্ষমতায়)। তাই আমার একটাই লক্ষ্য যতটুকু সময় পাই দেশের উন্নয়নটা যেন করে যেতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ২০০১ সালে সরকার গঠন করতে না পারার পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমরা যখন সরকার গঠন করি তখন দেখেছি ২০০৫-০৬ সালে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়। আমরা ধারাবাহিক সরকার গঠনের ফলে আমাদের উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে পারায় আজকে আমরা ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট দিতে পেরেছি। ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট দিয়েছি। আর সকলের বেতন ১২২ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছি। যেটা পৃথিবীর কোন দেশেই কোন সরকার কখনও করতে পারেনি। যে কারণে আজ সকল শ্রেনী-পেশার মানুষই কিছু না কিছু তার শুভ ফল পাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় পদ্মা সেতু নিয়ে তাঁর এবং পরিবারের সদস্য এবং মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়াতেই তারা এটা প্রমাণ করতে পারেনি বরং কানাডার আদালতে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রধান মন্ত্রী বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম এখানে জনগণের জন্য কাজ করতে এসেছি। নিজের ভাগ্য গড়ার জন্য নয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৫৪ সালে তিনি মন্ত্রীর মেয়ে ছিলেন। তাঁর বাবা দেশ স্বাধীন করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতির মেয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিলেন তিনি নিজে দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন-কাজেই দুর্নীতি করে নিজের ভাগ্য গড়ার থাকলে বহু আগেই করতে পারেতেন। যা তিনি করেন নি।
তিনি বলেন,‘অন্তত বাংলাদেশের মানুষের মাথা হেঁট করিনি। এইটুকু অন্তত গর্বভরে বলতে পারি। বরং মাথা উঁচু হয়েছে। বাংলাদেশ আজকে সমগ্র বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। যারা বাংলাদেশকে এক সময় অবহেলার চোখে দেখতো তারাও এখন বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখে। এটাই বাঙালির প্রাপ্ত ছিল যেটা আমরা আবার তাদের জন্য অর্জন করতে পেরেছি।’