আরবি শব্দ ‘যাকাত’ এর আভিধানিক অর্থ ‘যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশি হয়’।
অর্থাৎ, ‘যাকাত’ হচ্ছে ‘বরকত’। যার মানে, ‘পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা ও সুসংবদ্ধতা’। ইসলামের ধর্মের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হলো এই যাকাত।
অন্য চার স্তম্ভ— ঈমান, নামাজ, রোজা ও হজ্জের মতো যাকাত আদায় করাও মুসলিমদের জন্য একটি ‘ফরজ’ ইবাদত; বাংলায় যাকে ‘অবশ্য পালনীয় কাজ’ বলা যায়।
‘ফরজ’ হিসেবে যাকাত ‘কবে থেকে শুরু’ হয়
হিজরি দ্বিতীয় বর্ষ, অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইসলামে যাকাতকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুর’আনের অনেক জায়গায় নিয়মিত নামাজ আদায়ের আদেশের পাশাপাশি যাকাতের আদেশ প্রদান করা হয়েছে।
মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম অনূদিত কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আল্লামা ইউসূফ আল-কারযাভী’র লেখা ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ শীর্ষক বই থেকে জানা যায়, কুর’আনের ৩২টি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি এসেছে। এর মাঝে ২৭টি আয়াতে এটি নামাজের সাথে একত্র করে এসেছে।
তবে, কারও কারও মতে, কুরআনের ৮২টি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি নামাজের সাথে উদ্ধৃত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোরআনের প্রায় ৮০ জায়াগায় সালাতের পাশাপাশি যাকাতের কথা বলা হয়েছে।”
তবে ঐ সময়ের আগে কি যাকাতের প্রচলন ছিল না? ইসলামে কেন এটি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো?
যাকাত ব্যবস্থার পটভূমি
ইসলামে যাকাতকে কেন এতটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে, কিভাবে এটি পাঁচ ফরজের একটি হয়ে উঠলো, সেটা বুঝতে গেলে আমাদেরকে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আরও পেছনের দিকে তাকাতে হবে।
‘ইসলামের যাকাত বিধান’ বই থেকে জানা যায়, ইসলাম-পূর্ব সমাজে দুর্বল ও দরিদ্রদের সাথে ধনীদের পার্থক্য ছিল উল্লেখ করার মতো। ঐ সময়ের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তখন মানুষ মূলত দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত। হয় ধনী, নয়তো দরিদ্র। এ দু’য়ের মাঝে তৃতীয় শ্রেণির কোনও অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায় না।
এই বইয়ের প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে, প্রাচীন মিশর ছিল পৃথিবীর বুকে আল্লাহ’র জান্নাত। কারণ সেখানে এত বেশি ফসল ও খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হত, যা সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকগুণ বেশি লোকের জন্য যথেষ্ট হতো। কিন্তু তবুও সেখানকার দরিদ্র শ্রেণি খাবার থেকে বঞ্চিত হতো।
মিশরের ধনীরা গরীবদের জন্য উচ্ছিষ্ট বা তলানি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রাখতো না। কিন্তু ঐ উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবন ধারণ করা সেখানকার অধিবাসীদের জন্য অসম্ভব ছিল।
ব্যাবিলনেও দরিদ্রদের অবস্থা মিশরের মতো ছিল। ধনীদের উন্নতি, অগ্রগতি, ধন-সম্পদের কোনও ছিঁটেফোঁটা সেখানকার গরীব মানুষের ভাগ্যে জুটতো না।
প্রাচীন গ্রিক সমাজের অবস্থাও মিশর বা ব্যাবিলনের চাইতে খুব বেশি আলাদা ছিল না। সেখানে গরীবদের দিয়ে অত্যন্ত হীন কাজ করানো হতো এবং সামান্য কারণে গরীবদেরকে জবাই বা কতল পর্যন্ত করতো।
এরপর এলো স্পার্টার শাসনামল। প্রাচীনকালে স্পার্টা একটি বিখ্যাত গ্রিক সামরিক সাম্রাজ্য বা নগররাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐ সময়ে সেখানকার গরীবদেরকে সম্পূর্ণ অনুর্বর ও অনাবাদী জমিতে চাষাবাদের কাজে নিযুক্ত করা হতো। সেখানে তারা প্রাণপণ পরিশ্রম করেও খাদ্য উৎপাদন করতে পারতো না এবং এর ফলে খাবারের অভাবে মারা যেত।
তৎকালীন আবিসিনীয়ায় (বর্তমানে ইথিওপিয়া) দরিদ্ররা যদি কর পরিশোধ না করতে পারতো, তাহলে ধনীরা তাদেরকে ক্রীতদাসের মতো হাটে বাজারে বিক্রি করে দিতো।
সেই সময়ে বর্তমানের ইতালির রাজধানী রোম ছিলো আইন-বিধানের কেন্দ্রভূমি। কিন্তু ‘ইসলামের যাকাতের বিধান’ বইতে সেই সময়ের রোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, “দরিদ্ররা প্রতিদিন দরিদ্রতর হয়ে যেত, ধনীরা ক্রমশ অধিকতর ধনশালী হয়ে যেত। তারা বলতো, দেশের সব লোক ধ্বংস হোক, না খেয়ে মরুক। তাহলে তারা আর যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারবে না।”
কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ গড়ে উঠলো। কিন্তু তখন দরিদ্র শ্রেণির অবস্থা আরও মারাত্মক ও মর্মান্তিক হয়ে উঠেছিলো।
অর্থাৎ, গরীবদের শাসন, শোষণ, বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে সমস্ত কালে ধনীদের ভূমিকা এক ও অভিন্ন ছিল।
বৈষম্য দূর করতে ধর্মের ভূমিকা
ইউসুফ আল কারযাভী তার বইতে লিখেছেন যে পৃথিবীর সকল ধর্মেই মানবসমাজের এই অন্ধকার দিকটির প্রতি যথাসাধ্য দৃষ্টিপাত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘আসমানী ধর্মসমূহে দরিদ্র ও দুর্বল লোকদের কল্যাণের জন্য যে দাওয়াত ছিল, তা ছিল অধিকতর বলিষ্ঠ ও গভীর প্রভাবশালী’।
এখানে আসমানী ধর্ম বলতে ইসলাম, খ্রিস্টান, ইহুদী ধর্মকে বোঝানো হয়েছে। কারণ এই তিন ধর্মাবলম্বীরাই প্রধান আসমানী কিতাব—কোরআন, তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিলকে তাদের ধর্মগ্রন্থ মনে করে।
মুসলিমদের কাছে কোরআন ও ইহুদীদের কাছে তাওরাত তাদের ধর্মগ্রন্থ। আর তাওরাত, যবুর ও ইঞ্জিলের সংকলন বাইবেলকে নিজেদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মানেন খ্রিস্টানরা।
মুসলমানরা এই প্রধান চারটি গ্রন্থ সহ সকল আসমানি কিতাবকে ‘আল্লাহ্প্রদত্ত গ্রন্থ’ বলে বিশ্বাস করেন।
এখন, ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, শুধু কুরআনে না, এর আগে অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থেও যাকাতের কথা এসেছে। অর্থাৎ, ইসলামের আবির্ভাবের আগেও যাকাতের বিধান, এমনকি নির্দেশনাও ছিল।
অন্যান্য ধর্মে কি আসলেই যাকাতের বিধান ছিল?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, “ইসলামের আগেও এই নিয়ম ছিল। হয়তো অন্য আঙ্গিকে, অন্যভাবে ছিল। তাদের সময় রোজাও ছিল। এ প্রসঙ্গে কিন্তু বলা হয়েছে ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছিল।”
“কারণ পৃথিবীর কোনও জাতির ক্ষেত্রেই ‘সমস্যা সৃষ্টি হোক, কিন্তু সমাধান হবে না’, এমনটা তো চাননি আল্লাহ। সব নবীর সময়েই এই প্রেক্ষাপটগুলো আসছে এবং সেভাবে আয়াতও নাজিল হয়েছে।”
“ইসলাম মানুষের সব সমস্যার সমাধান দিয়েছে। যখন যে সমস্যাটা সামনে আসছে, সেটা নিয়ে আয়াত নাজিল হয়েছে এবং রাসূল মানুষদেরকে ডেকে এটা বলে দিয়েছে,” অধ্যাপক হক যোগ করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারীও বিবিসি বাংলাকে একই কথা বলছেন। তার ভাষায়, “যাকাত আগেও ছিল। মুসা (আ) এর সময়ও ছিল।”
যেমনভাবে, “নামাজও আগে ছিল। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আমাদের নবীর সময় ফরজ করা হয়েছে। যাকাতও তাই। এটি আগেও ছিল। কিন্তু আমাদের ওপর দ্বিতীয় হিজরি থেকে ফরজ হয়।”
ইউসুফ আল কারযাভীও তার বইয়ে লিখেছেন যে ইসলামের নবী ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের সময়েও নামাজ আদায় করার পাশাপাশী যাকাত দেওয়ার জন্য ওহী পাঠানো হয়েছে।
বইতে আরও বলা হয়েছে যে ‘দুর্বল ও দরিদ্র লোকদের প্রতি সহৃদয়তা ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ গ্রহণের বহু আদেশ ও নির্দেশ তাওরাত ও ইনজীলে’ দেওয়া হয়েছে।
ইসলাম ধর্মে ‘রোজার পরেই যাকাত’
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতে যাকাত সম্বন্ধে বলা আছে— ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে ধনীদের ওপর যাকাত যেভাবে ফরয করা হয়েছে, ‘অন্য কোনও ধর্মে এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নজির নেই’।
বুখারী ও মুসলিম মুসলিম হাদীস অনুযায়ী বাংলাপিডিয়াতে বলা হয়েছে, ’’নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের (ধনীদের) ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের নিকট থেকে আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।”
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হকও বলেন, “সমাজে গরীব আছে, মিসকিন আছে, অসহায় আছে; তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তখন এই ‘সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও’ আয়াত নাজিল হয়েছে।”
“অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা যাকাতের মূল উদ্দেশ্য। ধনীদের হাতে যেন সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে না থাকে, সম্পদের যেন সরবরাহ বাড়ে, অর্থের যেন সুষম বন্টনের মাধ্যমে যেন দারিদ্র্য বিমোচন হয়; এসবের জন্যই যাকাতকে ইসলামে ফরজ করা হয়েছে,” বলছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মি. পাটোয়ারী।
যাদের জন্য যাকাত ফরজ
অনেকের মধ্যে ধারণা আছে, নিজের বা পরিবারের অধিকারে থাকা মূল্যবান দ্রব্যাদি, যেমন- স্বর্ণ-রৌপ্যালঙ্কার, দামী রত্ন বা এ ধরণের জিনিস থাকলেই কেবল যাকাত দিতে হবে।
কিন্তু আদতে তা না। এক বছরের বেশি সময় ধরে সঞ্চিত স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন দলিল, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র যার আর্থিক মূল্য আছে ইত্যাদির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ, অর্থাৎ যাকাত প্রদানের উপযুক্ত পরিমাণ হয় এবং পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে ইসলামিক আইন অনুযায়ী যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক।
অধ্যাপক হকের মতে, “ইসলামের শুরু থেকেই শুধুমাত্র নিত্য ব্যবহার্য জিনিস (একটি বাড়ি, গাড়ি, পশু, নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ, বাসন-কোসন) বাদে যদি কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা, সাড়ে ৫২ ভরি রূপা অথবা এই পরিমাণ নগদ অর্থ এক বছর থাকে, তাহলে বছর শেষে তাকে ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হয়। সোনা রূপা মিলে যদি ঐ পরিমাণ হয়, তাহলেও দিতে হবে।”
এছাড়া, অনেকে মনে করেন যে ব্যাংক ঋণ থাকলে যাকাত দিতে হবে না। এটাও ভুল ধারণা বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
তিনি এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “ধরেন,একজন বড় ব্যবসায়ী। তার তো ব্যাংকে ঋণ আছে। এখন সে যদি বলে যে ‘আমি যাকাত দিবো কীভাবে, ঋণী ব্যক্তির জন্য তো যাকাত নাই’; তাহলে তো হবে না। এখানে ঋণ দ্বারা বোঝানো হয়েছে- এমন ঋণ যে সে বাধ্য হয়ে ঋণ করেছে।”
অর্থাৎ, ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পর তা দিয়ে যদি ব্যবসা বা মুনাফা করা হয়, তাহলে যাকাত প্রযোজ্য।
কারা যাকাত পাবেন
ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, আট ধরনের মানুষকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
ভিক্ষুক, মিসকিন (যিনি অভাবগ্রস্ত, কিন্তু কারও কাছে সাহায্য চাইতে পারেন না),
ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির ঋণমুক্তির জন্য, যাকাত বিভাগের/আদায়কারী কর্মচারী, নওমুসলিম,
আল্লাহর পথে (ফি সাবিলিল্লাহ), মুসাফির (এমন পথিক যে কোথাও গিয়ে নিঃস্ব হয়েছে)
দাসত্ব মোচনে
তবে দাসমুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করার বিধান থাকলেও বহু বছর ধরে দাস প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে সেটি এখন আর কার্যকর নয়।
এর বাইরে আরেক ধরনের যাকাত আছে, যেটিকে ফিতরা বলা হয়। অর্থাৎ, যদি কোনও ব্যক্তি শুধুমাত্র ঈদের দিন যাকাতের সমপরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তির মালিক হন, তখন তাকে ফিতরা দিতে হবে।