প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একটা কথাই বলবো যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাহলে নানা কথা না বলে গণতন্ত্রের চর্চা করুন। সেটাই বাস্তবতা।’
ভিন্ন পথে ক্ষমতা দখলে বিএনপি’র অপচেষ্টার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেজন্য তারাতো চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোন সাড়া লাভে ব্যর্থ হচ্ছে।’
দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস বিক্রির নিশ্চয়তা দিয়েই বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালের ভোটে জয়ী হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, ওই নির্বাচনের আগে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের সরকারি বাসভবনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয় এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতি তাকে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রির প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখান করে বেরিয়ে আসেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন সেখানে থেকে যান এবং তাদের মধ্যে এ সম্পর্কে রফা হয় ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি চলে আসি। খালেদা জিয়া থেকে যান। জিমি কার্টার এতোই খুশি হন যে, খালেদা জিয়ার ঘাড়ে হাত দিয়ে সেই লাঞ্চ থেকে বের হন।’ যার ছবিও সে সময়কার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা আমার জন্য এতো কঠিন ছিল না, যদি আমি একটু ক¤েপ্রামাইজ করতাম। সেই ক¤েপ্রামাইজটা হল- আমার দেশের গ্যাস আমার দেশের মানুষের কাজে লাগাবো না, সেটা বিক্রি করে দেব।’
ওই প্রস্তাবে না করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জাতির পিতার কন্যা। আমার দ্বারা এদেশের মানুষের এতোটুকু স্বার্থহানি হতে পারে না।’
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁকে একবার সরাসরি প্রস্তাব দিলেও তিনি নাকচ করেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যে গণতন্ত্র এনেছি সেই গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকলেই এদেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলতে পারবো, যেটা আমাদের মূল লক্ষ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন তিনি নির্বাচন করবেন না। কারণ আমাদের উন্নয়নের গতি দেখেই তারা ভিত হয়ে যায়। তারা জানে জনগণ বিএনপিকে আর কখনও ভোট দেবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি। যারা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করে, লাখো শহীদের রক্তাক্ত পতাকা তারা তুলে দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের সাজা হয়েছে, যাদের সাজা কার্যকর হয়েছে তাদের হাতে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া তাদের আহ্লাদ করে পতাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। মন্ত্রী বানিয়েছিল। যারা ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান, চোরাকারবারি আর দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দেশকে দিতে পারেনি। তাদের জনগণ কেন ভোট দিতে যাবে? ২০১৪ সালে নির্বাচন বানচালের নামে শত শত মানুষ হত্যা করলো তারা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৯২ দিন অফিসে বসেই তারা কি আন্দোলন করে। সেখানে বিরানীর প্যাকেট আনে আর খায়। সরকার উৎখাতের নামে অফিসে বসে আন্দোলনের নামে হুকুম দিয়ে মানুষ হত্যা করে। সরকার উৎখাত না করে নাকি আর ঘরে ফিরবে না। মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোন মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে মারতে পারে না। এখানে অফিসে বসে বসে হুকুম দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তার দল আর জামায়াত মিলে সাধারণ মানুষগুলোকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে।
বিএনপি’র ধ্বংস লীলার পরিসংখ্যান তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায় ১ হাজার ৭৭০টা গাড়ি তারা পোড়ালো, আরো প্রায় ২ হাজার গাড়ি ভাঙচুর করলো। ১৮টি রেল, ৭০টি সরকারি অফিস তারা পুড়িয়ে দিল। ৬টা ভূমি অফিস পোড়ালো। লঞ্চ, রেল, সরকারি অফিস, বিদ্যুৎ কেন্দ্র কোনকিছুই বাদ ছিল না। সব জায়গায় আঘাত করলো, পোড়ালো, মানুষ হত্যা করলো। রাস্তার পাশের হাজার হাজার গাছ তারা কেটেছে এবং আইন-শৃংখলা রক্ষকারি বাহিনীর ওপর তারা হামলা করেছে। ২০ জন পুলিশ সদস্য হত্যা করা হলো, বিজিবি সদস্যকে হত্যা করা হলো। ডিজিএফআই’র একজন অফিসারকে পর্যন্ত হত্যা করা হলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মায়ের সামনে ছেলেকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, বাবার সামনে তার সন্তানকে পুড়িয়ে মারলো। এই বীভৎস দৃশ্য কে সৃষ্টি করেছে? করেছে খালেদা জিয়া আর তার কুলাঙ্গার পুত্র। কাজেই একথা যেন দেশবাসী কোনদিন ভুলে না যায়। তারা (বিএনপি) এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটাতে পারে, মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে- এটাই নাকি তাদের আন্দোলন।
গণপ্রতিরোধে খালেদা জিয়ার তথাকথিত আন্দোলনের সমাপ্তি হলো উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ যখন বের হয়ে এসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো তখন খালেদা জিয়া আন্দোলন ফেলে অফিস থেকে বের হয়ে নাকে খৎ দিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে ঘরে ফিরে গেল।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, যে নির্বাচনেও পরাজিত, আন্দোলনেও পরাজিত তাকে ভবিষ্যতে দেশের মানুষ কেন ভোট দেবে?
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস বিকৃতি আর হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সূত্রপাত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতো ইতিহাস বিকৃতি পৃথিবীর কোনো দেশে আর নেই।
তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ কেউ খেতাবও পেয়েছেন। তবে তারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করতেন কি-না তা নিয়েই সন্দেহ আছে। কারণ, তারাই এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, পতাকা তুলে দিয়েছেন। আর তারাই এখন কী করে গণতন্ত্রের কথা বলেন?’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাসহ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ভারতে শরণার্থী আশ্রয়, মুজিবনগর সরকার গঠনসহ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার কিছু খন্ডচিত্রও তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঊষালগ্নে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনা দিতেন, প্রতিটি বাঙালি সেটি মেনে চলতেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
৯ মাসের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সম্ভ্রমহারা মা-বোন ও ৩ কোটি গৃহহীনের পুনর্বাসন, দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ অর্জনসহ দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ রক্ষায় জাতির পিতার পদক্ষেপের প্রসঙ্গও তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসে।
বিজয় দিবসে শুক্রবার বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে যানজটে পড়েন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গতকাল আমি যখন যাচ্ছিলাম, আমি ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে যাই। আমি গর্বিত, এবারের মতো এত মানুষের ঢল আগে দেখিনি। সব থেকে বড়ো কথা- যুবসমাজ, ছাত্র, জনতা সকলের অংশ গ্রহণটা ছিল চোখে পড়ার মতো।’
এবারের বিজয় দিবসে জনগণের মাঝে যে উল্লাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পেয়েছেন তাঁর প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাই আশার আলো দেখাচ্ছে যে, আমার ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এখন আর কেউ বাংলার মানুষকে বিকৃত ইতিহাস গেলাতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজয়ের চেতনাকে আমাদের ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধে যে আকাক্সক্ষা নিয়ে লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছেন, আমাদের বিজয় এনে দিয়েছেন সেই বিজয়ের পতাকাকে আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে।
বাংলার লাল-সবুজ পতাকা যেন বিশ্বে সব সময় মর্যাদা পেতে পারে, সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। আর এর মাধ্যমেই শহীদদের আত্মত্যাগকে প্রকৃত মর্যাদা দেয়া হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।