অগ্রসর রিপোর্টঃ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, কোন বিচারপ্রার্থী যেন হয়রানির শিকার না হন, সেলক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সুপ্রিমকোর্ট বার-এর সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও গৃহিত পদক্ষেপ বিষয়ে বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন বিচারপ্রার্থী যেন হয়রানির শিকার না হন, বিচার ব্যবস্থায় তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে কিভাবে সাজাবেন তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দিনরাত ভাবতেন। এর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ‘সংবিধান’ রচনা ছিলো অন্যতম। সংবিধান প্রণয়নে গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি (ব্যারিস্টার আমীর) ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। আমরা সংবিধান সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতবিনিময় করতাম। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তার চিন্তা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ সংগ্রামে যে শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন সংবিধানে তার প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি একটি শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশের সংবিধানে তার প্রতিফলনও ছিলো। যেখানে স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়।
ব্যারিস্টার আমীর বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার গভীরতা আমরা দেখেছি। বঙ্গবন্ধু সকলের জন্য ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন বলেই মামলায় যেন দীর্ঘসূত্রিতা না ঘটে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, অনেক সময় প্রতিহিংসাবশত: অন্যের অনিষ্ট করতেও একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে থাকে। কেননা মামলা মানেই একটা হয়রানি। আদালতে যাতায়াত, অর্থ ও সময়ের অপচয়। এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু বুঝতেন। তাই তার এ অভিজ্ঞতার বিষয়টি উল্লেখ করে শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে আমাদের তার অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন। যাতে জনগণ বিচারাঙ্গনে কোনরূপ হয়রানির শিকার না হন।
তিনি বলেন, ল’ সেটেল করার জন্য আমরা একটা ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে মতামত দেই। এর ভিত্তিতেই সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ প্রবর্তিত হয়। যেমন ব্রিটেনে রয়েছে ‘প্রিভি কাউন্সিল’। ব্যারিস্টার আমীর আপিল বিভাগের এখতিয়ার বিষয়ে সংবিধান প্রদত্ত বিভিন্ন আর্টিকেল উল্লেখ করেন।
ব্যারিষ্টার আমীর বলেন, বঙ্গবন্ধু যেরূপ বিচার ব্যবস্থা চেয়েছিলেন, তার অনেক কিছু বাস্তবায়িত হলেও এখনো অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগে দেয়া মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ পৃথক করার ক্ষেত্রে অনেক কাজ হলেও এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি বলেন, এখনো অনেক বিষয় আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক হয়ে থাকে। এজন্য বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত হবে।
ব্যারিস্টার আমীর বলেন, প্রধান বিচারপতি হলেন ‘হেড অব জুডিশিয়ারী’। এখন তাকে বিচার কাজ ও বিচার বিভাগ সংক্রান্ত প্রশাসনিক কাজ উভয়ই করতে হচ্ছে। আলাদা সচিবলায় হলে এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির প্রশাসনিক কাজের চাপ আর থাকত না। এতে বিচার বিভাগ উপকৃত হতো। বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে বঙ্গবন্ধু যে বিচার ব্যবস্থা চেয়েছেন তার স্বপ্নও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে বলে মত দেন ব্যারিষ্টার আমীর।
বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও গৃহিত পদক্ষেপ বিষয়ে বাসস-এর সঙ্গে কথা বলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট বার এর সাবেক সভাপতি (সাবেক বিচারপতি) এডভোকেট এএফএম মেজবাহউদ্দিন।
তিনি বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে ১৯৫২ সালের সংগ্রামের বিষয় উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আইন অঙ্গনের লোক না হলেও এ অঙ্গনের প্রতি তার আলাদা দরদ ছিলো। বিচার বিভাগের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মেজবাহউদ্দিন বলেন, বিচার বিভাগ ও এ বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্তদের প্রতি তার বিনয় ছিলো অসাধারণ। বিচারক ও আইন কর্মকর্তা নিয়োগে মেধা ও দক্ষতার বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিতেন বঙ্গবন্ধু। হাইকোর্টের পাশাপাশি, জেলা ও দায়রা জজ পদেও আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের দাবী উঠেছিলো। এ প্রেক্ষিতে কয়েকজন আইনজীবী এ পদে নিয়োগও পান। এদের মধ্য থেকে পরে কেউ কেউ হাইকোর্টেও নিয়োগ পান। পরবর্তীতে আপিল বিভাগেও নিয়োগ পান এবং দেশের প্রধান বিচারপতি হন। এ বিষয়ে মেজবাহউদ্দিন বিচারপতি এটিএম আফজালের কথা উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতার কথা স্মরণ করেন মেজবাহউদ্দিন।
সুপ্রিমকোর্ট বার-এর মূল ভবনটি বঙ্গবন্ধুর সময়ে নির্মিত হয়েছিলো। সর্বোচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধুর ষ্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেজবাহউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু এখানে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের বিষয়ে তার অভিপ্রায়ের কথা বলেন। তখন বঙ্গবন্ধু ‘বাংলা ভাষা’ প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তখন ওই অনুষ্ঠানে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যসহ অন্যরা বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি প্রস্তাব দেন। তখন বলা হয়, আমাদের দেশের প্রায় সব আইনই বৃটিশ আইন। এসব আইন বাংলায় অনুবাদ করে তা বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োগে জাতীয় সংসদ কর্তৃক অথেন্টিকেশন করা। তাতে বঙ্গবন্ধু একমত পোষণ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে বর্বরোচিত ও নির্মমভাবে সপরিবার হত্যা করে ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীরা। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় বৃটিশ আইনগুলো বাংলায় আর অনুবাদ করা হয়নি। এডভোকেট মেজবাহউদ্দিন বলেন, এখনো সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলণে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হয়নি ।
প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।