নিজস্ব সংবাদদাতা- ফরিদপুরের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। এনসিসি ব্যাংকে জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ২০১০ সালে। এর পর গত তিন বছরে ২০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছে তার পরিবার। ফরিদপুর শহরে নির্মাণ করেছেন বিশাল গ্লাস টাওয়ার। এসবই তিনি করেছেন ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে। এনসিসি ব্যাংকের হিসাবেই ব্যাংকটি থেকে সিদ্দিকুর রহমান আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ সালের আয়কর বিবরণী অনুযায়ী সিদ্দিকুর রহমানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ২ কোটি টাকার প্রাইজবন্ড, ১ কোটি টাকার স্বর্ণ, ১ কোটি টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং ২ কোটি টাকার আসবাব ও ইলেকট্রনিকসামগ্রী। ওই বছর সিদ্দিকুর রহমান কর দেন ৩০ হাজার টাকা। তবে হিসাবের বাইরে সিদ্দিকুর রহমানের নামে-বেনামে আরো সম্পদ রয়েছে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিদ্দিকুর রহমান ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরে ৭ শতাংশ জমি ভবনসহ ৫ কোটি টাকায় বায়নানামা করেন। কিন্তু কর ফাঁকি দিতে একই বছর তা ২ কোটি ৩২ লাখ টাকায় রেজিস্ট্রি করেন। সিদ্দিকুরের স্ত্রী শিল্পী আকতারীর ২০১৩-১৪ সালের আয়কর বিবরণীতে দেখা যায়, তার সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রাইজবন্ড ও ৩ কোটি টাকার স্বর্ণ। ওই বছর তিনি কর দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। তিন বছর আগে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন সিদ্দিকুরের ছোট ভাই মো. রাসেল মিয়া। এখন তিনি গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ ব্যবসায়ী। ঢাকার আরামবাগে রাসেল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী তিনি।
এনসিসি ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সিদ্দিকুরের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় রাসেল মিয়াকে তলব করে তদন্ত কমিটি। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন রাসেল মিয়া। ভাইয়ের অপরাধের সঙ্গে নিজের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে তদন্ত কমিটিকে জানান তিনি। যোগাযোগ করা হলে ভাইয়ের অপকর্মের বিষয়টি স্বীকার করেন রাসেল মিয়া। তিনি বলেন, ভাই ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন। তবে কত টাকা নিয়েছেন, তা আমার জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে মীমাংসার চেষ্টা চলছে। ব্যাংকের লোকজনও তাদের বাড়িতে গেছেন। তাদের সঙ্গে ভাইয়ের কথা হয়েছে। তবে তার ব্যবসায় ব্যাংকের কোনো অর্থ নেই।
তবে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস বা মীমাংসার বিষয়টি অস্বীকার করেছে এনসিসি ব্যাংক। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, সিদ্দিক ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি করেছেন। চোরের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা আপস হতে পারে না। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। সিদ্দিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের তাম্বুলখানার মুড়ালীদায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার বাবা মাসুম মিয়া পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়ে ফরিদপুরে বাড়ি করেন। জুট মিলে সাধারণ শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। বড় ছেলে সিদ্দিকুর রহমান চাকরি করতেন প্রেসে। ছোট ছেলে ছিলেন কারখানার হেলপার। কিন্তু ২০১০ সালে সিদ্দিকুর ব্যাংকে চাকরি নেয়ার পর তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। গত দুই বছরে তা মানুষের চোখে পড়ে। এ সময়ে সিদ্দিকুর ফরিদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ৫ কোটি টাকা দিয়ে একটি ভবন কেনেন। পরে আরো ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই ভবন সংস্কার করেন। এছাড়া কৃষিজমি কেনেন ২ কোটি টাকার। ঢাকায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে ছোট ভাই রাসেলের অ্যাকসেসরিজের ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বোন জামাইও সিদ্দিকের টাকায় ব্যবসা করছেন।
সিদ্দিকুরের এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাসুম মিয়া আমাদের মতোই দরিদ্র মানুষ ছিলেন। কিন্তু গত তিন বছরে বড় ছেলের কল্যাণে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। কেউ জমি বিক্রি করতে চাইলেই সিদ্দিকুর তা কিনে নেন। সিদ্দিকুরের ফরিদপুরের সম্পদ দেখাশোনা করেন শহরের শিশু হাসপাতালের স্টোর কিপার আবদুল জলিল। তার ক্যাশিয়ার হিসেবেই তিনি পরিচিত। ফরিদপুরের জমি ও ভবন ক্রয়ে তিনিই সহযোগিতা করেন সিদ্দিকুর রহমানকে। আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জমিজমা, সম্পদ কেনাবেচায় কাউকে না কাউকে সহায়তা করতে হয়। সে হিসেবে আমি সিদ্দিকুরকে সহায়তা করেছি। তবে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভাগীয় মামলা হওয়ার পর নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন সিদ্দিকুর রহমান। এখন আর টাকা-পয়সা খরচ করছেন না তিনি। ফরিদপুরের নিলটুলির গ্লাস টাওয়ারে হাসপাতাল করার পরিকল্পনা থাকলেও আপাতত ফেলে রাখা হয়েছে। ছয়তলা ভবনের নিচতলায় ওষুধের দোকান দিলেও অন্য সব ফ্লোর ফাঁকা পড়ে আছে। সিদ্দিকুর রহমানের কাছের লোকজন বলছেন, পুলিশ, ট্যাক্সের লোক ও ব্যাংক সামলাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এনসিসি ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের ওই ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন ব্যাংকটির রেমিট্যান্স শাখার ঊর্ধ্বতন পাঁচ কর্মকর্তা। তারা হলেন— রেমিট্যান্স বিভাগের প্রধান এসভিপি এবিএম জসিমউদ্দিন আহমেদ, এসএভিপি সাবিনা ইয়াসমিন, ভিপি মঞ্জুরুল হক আকন, এফএভিপি সালাউদ্দিন আহমেদ ও এভিপি শামসুর রহমান খান।
তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিদ্দিকুরের কারণে বিপদে রয়েছি আমরা। ঘরে-বাইরে সবসময় আমাদের সামাজিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আমরা সবাই চাই সিদ্দিকুরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।